নিজের গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন সোমালিয়ায় জলদস্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া ‘এমভি আব্দুল্লাহ’ জাহাজের প্রকৌশলী হোসাইন মোহাম্মদ আলী।
জলদস্যুরা কীভাবে জাহাজে ওঠে তাদের জিম্মি করে সে বর্ণনা দেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (১৬ মে) বেলা ১১টায় বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি ইউনিয়নের উমরের পাড় গ্রামে ফেরেন তিনি। খবর পেয়ে স্বজনদের পাশাপাশি এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিরাও আসেন মোহাম্মদ আলীকে দেখতে।
বাড়ি পৌঁছে হোসাইন মোহাম্মদ আলী পুরো ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণে বলেন, ১২ মার্চ আমার ডিউটি অফ ছিল বিধায় ঘটনার সময় আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ইমারজেন্সি অ্যালার্ম বেজে ওঠায় ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে ব্রিজের দিক যেতে যেতে মাইকে শুনছিলাম সন্দেহভাজন একটি বোট আমাদের জাহাজের কাছাকাছি আসছে। আমরা সবাই ব্রিজে গিয়ে দেখতে পাই একটি বোট জাহাজের বাম দিক থেকে আসছে। তবে সেখান থেকে দস্যুরা জাহাজে উঠতে না পেরে পেছন থেকে ঘুরে ডান দিকে আসে। পরে লেডার আর জ্যাক টাইপের কিছুর সাহায্যে জাহাজে উঠে যায় দস্যুরা।
তিনি বলেন, এর আগেই আমাদের ক্যাপ্টেন সবার সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। আর সেই সময়ের মধ্যেই আমাদের সবাইকে জাহাজের গোপন রুমে নিয়ে রাখেন চিফ অফিসার। তবে ওরা (জলদস্যুরা) জাহাজে উঠেই ক্যাপ্টেন আর চিফ অফিসারকে আটকে ফেলায় বাধ্য হয়ে আমাদের সারেন্ডার করতে হয়। তখন হাত উপরে দিয়ে অনেকটা মুরগির মতো করে সবাইকে ব্রিজে যেতে হয়। হাঁটু গেড়ে সবাই সেখান অবস্থান নিয়ে দেখি দস্যুদের সবার হাতে অস্ত্র। সেগুলো না চিনলেও দেখা মুভির সাথে মিলিয়ে মনে হয়েছে একে ৪৭ হবে।
জাহাজের এ প্রকৌশলী বলেন, যেটুকু শুনেছি এই জলদস্যুরা এক-দেড়মাস আগে ইরানিয়ান একটি ফিশিং বোট জিম্মি করে আর সেটা নিয়ে মধ্যসাগরে ওরা ঘুরছিল বড় জাহাজ আটকানোর জন্য। আমাদের ধরার পর ওরা ইরানি জাহাজকে রিলিজ করে দেয়।
তিনি বলেন, প্রথম দফায় ওরা চারজন এলেও পরে আরও এসে ১৩-১৪ জন হয়। পরে একটু রিলিজ দিলে সবাই যে যার মতো করে বাসায় ও অফিসে যোগাযোগ করি। এরপর ওরা ফোন নিয়ে নেয় এবং আমাদের সবাইকে ব্রিজেই থাকতে হয়েছে।
আলী বলেন, প্রথম তিনদিন খুব ভয়াবহ দিন কেটেছে। প্রথমদিকে খবরটি ছড়িয়ে যাওয়ার পর একটি ভারতীয় এয়ারক্রাফট এসে জাহাজের রেডিওতে ডাকছিল। তবে অস্ত্রের মুখে জিম্মি ক্যাপ্টেনকে কোনো রিপ্লাই দিতে মানা করেছিল দস্যুরা। সব থেকে ভয়ের বিষয় ছিল, ওরা সবসময় অস্ত্র লোড করে রাখতো, কোনো ভুল হলেই আমাদের কেউ না কেউ মারা যেত।
মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, এরপর দ্বিতীয় রাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি নেভি শিপ এসে উদ্ধারের চেষ্টা করছে। তবে তাদের অনেক থ্রেট করছিল দস্যুরা। এমনকি তারা ১ থেকে ১০ গুনেই ওপেন ফায়ার করেছে। আর তখন আমরা খুব ভয় পেয়ে ফ্লোরে শুয়ে ছিলাম। পরে ক্যাপ্টেন স্যার বাধ্য হয়ে নেভি শিপকে দূরে চলে যাওয়ার অনুরোধ জানান। যদিও নেভি শিপ প্রথমে যায়নি, এরপর বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে সেটি দূরে চলে যায়। নেভি শিপ কাছাকাছি থাকলে বা আসলে আমাদের অবস্থা ভয়াবহ হতো, আর দূরে গেলে একটু শিথিলতা পেতাম।
পোর্ট থেকে বের হওয়ার আগেই সবার জন্য জাহাজে এক থেকে দেড় মাসের খাবার নিয়ে নেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, রমজান মাস হওয়ায় ক্যাপ্টেন স্যারই পর্যাপ্ত বাজার করে নিয়েছিলেন। তার ওপর তিনি নিজ থেকে উদ্যোগ নিয়ে কোম্পানিকে বলে বেশি পানি জাহাজে নিয়েছিলেন। পানি না থাকলে আমাদের দুঃখ ছিল, এজন্য ক্যাপ্টেন স্যারকে ধন্যবাদ। ফলে শেষদিক তেমন কষ্ট হয়নি।
তিনি বলেন, দস্যুদের আক্রমণের পর চাচ্ছিলাম না যে পরিবারকে জানাব, তবে কি হবে সেই চিন্তায় বড়ভাইকে জানিয়ে বলেছিলাম নেটওয়ার্ক সমস্যার দোহাই দিয়ে যেন তিনি বাসায় সবাইকে বুঝিয়ে রাখেন। পরে পরিস্থিতি খারাপ দেখে, জীবনে আর কথা বলতে পারব কিনা এমন শঙ্কায় সবার সঙ্গে কথা বলেছি। আর যখনই কথা হয়েছি তখনই ভালো কিছু বলার চেষ্টা করেছি বাসায়, যাতে তারা উদ্বিগ্ন না হয়।
দস্যুদের সঙ্গে থাকাটাই অনেক কষ্টসাধ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ওদের আচরণে মনে হয় ওরা এখনও জঙ্গলের মানুষের মতো। ওদের চলাফেরা খাওয়া-দাওয়ার স্টাইল সবই ভিন্ন। মানে ওদের মাঝে সভ্যতাই আসেনি এখনও। ওদের কথা কিছু বুঝতাম না, যা বুঝতে হতো তা সবই আকার-ইঙ্গিতে। যদিও শেষের দিকে একজন ট্রান্সলেটর আসার পর কিছুটা সুবিধা হয়েছে।
প্রথমদিকে দস্যুদের আসার কারণ না বুঝলেও মুসলিম দেখে কিছুটা শিথিল আচরণ দেখিয়েছে মাঝে মাঝে। আমরাও চেষ্টা করেছি ওরা যাতে অ্যাগ্রেসিভ না হয় সেভাবেই চলার।
তিনি বলেন, প্রথমে ১৩ জন থাকলেও আড়াই দিন পর সোমালিয়া পৌঁছালে জাহাজে ৩০-৩৫ জন ওঠে। আর শেষ দিকে ৬০-৬৫ জন হয়ে যায়। এরপর ওরা আমাদের সব খাবার খেয়ে শেষ করে ফেলে। তবে শেষের দিকে এসে ওদের আচরণে মনে হচ্ছিল আমরা ছাড়া পাব। আর ঈদের দুই তিনদিন আগ থেকে ক্যাপ্টেন স্যার দস্যুদের বুঝিয়ে ঈদের জামাতটা করার ব্যবস্থা করেন। যাতে আমাদের মন-মানসিকতা ভালো থাকে, মনোবল বাড়ে।
তবে ঈদের জামাতের ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দস্যুরা সবাইকে ডেকে নেয় এবং কে ছবিটি প্রকাশ করেছে তাকে সামনে আসতে বলে। তবে কপাল ভালো তখন কোম্পানি কিছু একটা ফিডব্যাক দিয়েছিল আর দু-দিন পরেই আমরা ছাড়া পাই।
তিনি বলেন, মুক্তির দিন বেলা ১১টার দিকে সবাইকে একটি জায়গায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে বলে। এরপর ছোট একটি বিমান থেকে তিনটি বস্তা ফেলতে দেখি, তবে তার মধ্যে কি ছিল অনুমান করতে পারিনি। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর জানতে পারি ডলার ছিল বস্তায়।
তিনি বলেন, দস্যু আক্রমণের সাথে সাথে আমার থেকেও পরিবারের কথা বেশি মাথায় এসেছিল। বাবা- মা, স্ত্রীর কি হবে এটা ভেবেই কষ্ট লেগেছে বেশি। ওই সময়গুলো মৃত্যুর চেয়েও খারাপ মনে হয়েছিল। মৃত্যু হয়ত হঠাৎ করেই হয়ে যায়, কিন্তু এখান থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব তা কেউ বুঝতে ছিলাম না। ফলে ওখান থেকে দেশে ফিরব সেটাই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবনা ছিল। তবে আল্লাহর রহমতে সুস্থভাবে পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি, দেশবাসী গ্রামের মানুষের মাঝে আসতে পেরেছি। আর এত তাড়াতাড়ি ফিরব তাও ভাবিনি। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সরকার, স্বরাষ্ট্র-পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আমাদের কোম্পানির মালিক, মালিকের ছোট ছেলে, সিও স্যারসহ কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
হোসাইন মোহাম্মদ আলী বাড়িতে সুস্থভাবে ফিরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করে বিশারকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আলীর বিষয়টি জানার পর থেকে প্রশাসন ও এই পরিবারের সঙ্গে সমন্বয় করে গেছি। এখন আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে ভালো লাগছে।
আর ছেলে ফিরে আসায় আজ ঈদের দিন মনে করা বাবা এমাম হোসেন মোল্লা বলেছেন, এ খুশি আপনাদের বোঝাতে পারব না। ও যে ভালোভাবে ফিরে এসেছে এটাই শুকরিয়া। প্রধানমন্ত্রীসহ ওদের কোম্পানির সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
আলীর স্ত্রী ইয়ামনি বলেন, দস্যুদের কাছে জিম্মির কথা শুনে পরিবারের সবাই ভেঙে পড়েছিল। সবাই অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে শক্ত রাখার চেষ্টা করি। সেই সঙ্গে তিনি ফিরবেন আল্লাহর ওপর সেই ভরসা রাখি। আর এখন তো তিনি বাসায় চলেই আসলেন। আজ আমাদের বাসায় ঈদ।
এদিকে সন্তান ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মা নাছিমা বেগম, বোন মারিয়া সবাই বেশ উচ্ছ্বসিত। আদরের আলীকে নানান খাবারে আপ্যায়িত করেই চলছেন।
আর আলীদের জাহাজের সঙ্গে ঘটা এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত কারার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা।