ছোটবেলার ঈদ

::
প্রকাশ: ২ years ago

মানুষের জীবন স্মৃতিময়। প্রতিটি মানুষের রয়েছে হাজারো রঙিন স্মৃতি। কিছু স্মৃতি থাকে যা বার বার মনকে আন্দোলিত করে। নিয়ে যায় অতীত জীবনে। ছোটবেলার স্মৃতির মধ্যে ঈদের স্মৃতি সবচেয়ে সুখকর। পবিত্র রমজান মাস আসলে মন হারিয়ে যায় ছোটবেলার সেইসব দিনগুলোতে।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, একটা করে রোজা যায়, আমরা ঈদের আগমনের দিন গুণতে থাকি। আরমাত্র ষোল দিন…, পনেরো দিন…এগারো দিন…সাত দিন…তিন দিন… এরপর সেই কাঙ্খিত দিন।

ঈদের আগে কত কত প্রস্তুতি। রোজা রাখা। এ নিয়ে আরেক মজার স্মৃতি। বড়রা বলতেন, রোজা না রাখলে ঈদে কোনো আনন্দ নাই। তাই ছোটবেলা থেকেই রোজা রাখতাম। যখন খুব ছোট ছিলাম বয়স পাঁচ কি ছয় বছর তখন মা বলতেন, ছোটদের দিনে তিনটি রোজা। তিনবেলা তিনবার খেলেই তিনটি হয়ে যাবে। এখন অবশ্য আমরা আমাদের ছোট ছেলে-মেয়েকে বাবা-মার সেই কথাগুলোই বলে থাকি। তোমরা ছোট তোমাদের দিনে তিনটি রোজা। যখন বয়স আট-নয় হলো তখন রোজা রাখা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো বন্ধুদের মাঝে। কে কার চেয়ে কয়টি বেশি রোজা রাখতে পারে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা। একটা করে রোজা যায় আর ভাবতে থাকি আব্বা কবে নতুন জামা কিনতে আমাদের ভাই-বোনদের সাথে নিয়ে মার্কেটে যাবে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। ঈদের বোনাস পেলেই পরের দিন আমাদের নিয়ে মার্কেটে যেতেন নতুন জামা-কাপড় কিনতে। আমাদের জন্য প্যান্ট-শার্ট, আর বোনদের জন্য থ্রি পিস এবং সাথে গজ কাপড়। আম্মা বোনদের কাপড় নিয়ে দর্জি খালার বাসায় যেতেন কাপড় সেলাই করতে। বোনেরা উৎসুক নয়নে অপেক্ষা করতেন কখন জামা বানানো শেষ হবে।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

এটা মনে হয় সবার জীবনে একই চিত্র, নতুন জামা ঈদের আগে কাউকে দেখানো যাবে না। আগে দেখে ফেললে ঈদ হবে না। আমরাও তাই ঈদের আগ পর্যন্ত জামা কাপড় লুকিয়ে রাখতাম। বন্ধুরা দেখতে চাইলেও তা দেখাতাম না।

ঈদের আগে আমরা বন্ধুরা এবং সাথে বড় ভাই বোনেরা কিছু জিনিস বানাতাম। বাঁশ চিকন করে কেটে সেটা দিয়ে বাক্স বানাতাম। রঙিন কাগজের ওপর ঈদ মোবারক লিখে সুন্দর করে কাটতাম। তারপর বাক্সের চারপাশে সুন্দর করে সেই রঙিন কাগজ মুড়ে দিতাম। সেটাকে সিঁড়িতে ঝুলিয়ে ওপর থেকে ভেতরে বাল্ব লাগিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিতাম। চারপাশ থেকে ঈদ মোবারক লেখাগুলো জ্বল জ্বল করত। কী যে ভালো লাগত।

আমাদের সময় ঈদ কার্ড, ভিউকার্ডের প্রচলন ছিল। দশ-বার রোজার পর থেকে এলাকার ছোট ভাইয়েরা শখ করে রাস্তার কোনে চেয়ার টেবিল নিয়ে বিভিন্ন ধরণের ঈদকার্ড, ভিউকার্ড সাজিয়ে বসতো। আমি সেখান থেকে পছন্দ মতো কিনে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বন্ধুদের সাথে বিনিময় করতাম।

সাতাশ রোজার দিন হাতে মেহেদি রাঙানো হতো। সেদিন সকালে বোনদের সাথে গাছ থেকে মেহেদি পাতা ছিড়ে পাটায় বেটে হাতে লাগাতাম। এখানে বলে রাখা ভাল। আমার বোন ও তার বান্ধবীরা সবাই তাদের হাতে বিভিন্ন আলপনা আঁকত। তাদের হাত রাঙানোর পর অবশিষ্ট বাটা মেহেদি দিয়ে আমার ডান হাতের দুই একটি আঙুলের মাথায় লাগিয়ে দিত। কিছুক্ষণ পরপর লাগানো মেহেদি ওঠিয়ে দেখতাম লাল হয়েছে কিনা।

ঊনত্রিশ রোজার দিন ইফতার সেরেই দৌড়ে রাস্তায় চলে যেতাম ঈদের চাঁদ দেখার জন্য। ছোট বড় সবাই মিলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কার আগে কে চাঁদ দেখেছে তা নিয়ে হৈচৈ, দৌড়াদৌড়ি-সেটা ছিল অন্য রকম এক অনুভূতি। সেইসাথে নজরুলের ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে গানটি আনন্দের অনুভূতিকে শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। চাঁদ দেখার পর বন্ধুরা সবাই মিলে হৈহুল্লোর করে বাসায় আসতাম। বাসায় এসে সিঁড়ির সব ভাই- বোন ও বন্ধুরা মিলে রঙিন কাগজ কেটে পতাকা বানিয়ে নীচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত সাজাতাম। উচ্চ শব্দে গান বাজাতাম, তারাবাতি জ্বালিয়ে আকাশের দিকে ছুড়ে মারতাম, লুকিয়ে বাজিয়ে ফুটাতাম। এগুলোছিল অন্যরকম এক আনন্দ। রাতে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। সকাল হলেই ঈদ।

ঈদের দিন সকাল বেলা উঠেই গোসল সেরে নামাজের জন্য তৈরি হয়ে মায়ের হাতে রান্না করা সেমাই, পায়েস খেয়ে ভাই-বোন সবাই মিলে আব্বার সাথে ঈদগাঁয়ে যেতাম। নামাজ শেষে বন্ধুসহ ছোট বড় সকলের সাথে কোলাকুলি। দোকান থেকে নানা রঙের বেলুন, বাঁশি কিনে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বাসায় ফিরতাম। ততক্ষণে আম্মা অনেক মজাদার রান্না শেষ করেছে। আম্মার বানানো মজাদার খাবার খেয়ে সকালের নাস্তা সেরে নতুন কাপড় পরে বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়তাম। পরিচিত, সামান্য পরিচিত অনেক বাসাতেই যেতাম। ওনারা আমাদের আদর করে, যত্নসহকারে সেমাই, জর্দা পায়েস, নুডলস, চটপটি, মাংস, পোলাও খেতে দিত। কিছু বাসা ছিল একেবারেই কমন। যা না গেলেই নয়। শিউলীদের বাসা, তপন, নাজমা খালার বাসা, ইসমাঈল স্যার, ফিরোজদের বাসাতে যাওয়া ছিল আবশ্যিক। তপনের আম্মা অনেক মজা করে সেমাই রান্না করতেন কয়েক রকমের সেমাই। আমি খুব মজা করে খেতাম। বন্ধুরা সারাদিন ঘুরাঘুরি করতাম। আব্বা-আম্মা কিছুই বলতেন না। ঈদের দিন ছিল ছুটি। মুক্ত চিন্তে পাখা মেলে এদিক সেদিক ঘুরতে পারতাম।

সারা বছর মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা, আব্বা-আম্মার ও পরিচিতজনদের কাছে থেকে পাওয়া সেলামির টাকা দিয়ে দোকান থেকে খেলনা কিনতাম। আমাদের সময় খেলনা বলতে- প্লাস্টিকের গাড়ি, টিনের স্টিমার, কাঠের বন্দুক, স্টিলের পিস্তল আরও কয়েক ধরণের ছিল। টিনের স্টিমার কিনে বাসায় নিয়ে এসে ভেতরে তেল ভরে সলতেতে আগুন দিয়ে গামলার পানিতে ছেড়ে দিতাম। স্টিমার পানিতে চক্রাকারে ভেসে বেড়াতো। প্লাস্টিকের গাড়িতে সুতা বেঁধে রাস্তায় গিয়ে টেনে টেনে চালাতাম। কাঠের বন্দুক ও পিস্তল দিয়ে বন্ধুদের সাথে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। পিস্তলের জন্য কাঠের ভেতর বারুদ ভরা গুলি পাওয়া যেত। ফায়ার করলে আগুনের ঝলক দিয়ে ভীষণ শব্ধ করে কাঠের গুলি অনেক দূর পর্যন্ত যেত। সেগুলো আজ শুধুই স্মৃতি।

সারাদিন ঘুরাঘুরির পর রাত আটটার দিকে বাসায় চলে আসতাম। বাসায় ফিরে আম্মার রান্না করা খিচুরি, পোলাও, মাংস পেট ভরে খুব মজা করে খেতাম। রাতের খাবার পর টিভি দেখতাম। আমাদের সময় এখনকার মতো প্রতিটি বাসায় বাসায় টিভি ছিল না। দুই একটি বাসায় ছিল। তাও আবার সাদা-কালো। তখন তপনদের বাসায় টিভি ছিল। ওদের বাসায় গিয়ে দেখতাম। রাত আটটার খবরের পর আমজাদ হোসেনের একটি নাটক হতো। নাটকের নামটি মনে না পড়লেও কিছু কথা মনে আছে, যেমন আমজাদ হোসেন তার স্ত্রীকে ডাকত ও জবা, কুসুমের মা, বাঙা চরিত্রে যিনি ছিলেন, তিনি বলতেন টাকা দাও দুবাই যামু এবং রাত দশটার খবরের পর বিশেষ আকর্ষণ ছিল আনন্দ মেলা। আনন্দ মেলা ছিল ছোট বড় সকলের খুবই প্রিয় একটি অনুষ্ঠান। রাতে আনন্দ মেলা দেখতে না পারলে সারাদিনের আনন্দ যেন মাটিই হয়ে যেত। এভাবেই ঈদের দিন আনন্দ করে শেষ হয়ে যেত।

এভাবেই ঈদ যায় ঈদ আসে অপেক্ষায় থাকি পরের ঈদের। আজও ভুলতে পারি না ছোটবেলার ঈদের দিনগুলোর কথা। মনে পড়লে হারিয়ে যাই গহীন এক অরণ্যে। আজও ঈদ হয়, আনন্দ হয়। কিন্তু খুঁজে পাই না ছোটবেলার সেই আনন্দ।

লেখক: মো. নবী আলম; সাংবাদিক।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net