ছয় বছরে রোহিঙ্গা সংকট, প্রত্যাবর্সনই একমাত্র সমাধানের পথ

:: নাজিফা নাওয়ার ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

২০১৭ সালে মায়ানমার জান্তাবাহিনীর নির্মম গণহত্যা মোটামুটি এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা মুসলমানকে বাংলাদেশী শরণার্থী শিবিরে যেতে বাধ্য করে, যার ষষ্ঠ বার্ষিকী এবছর ২৫ আগস্ট। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” শুরু করে, গ্রামগুলো পুড়িয়ে ছাই করে দেয় এবং রোহিঙ্গাদের জান বাচাতে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। সেসময় ৭লক্ষ ৪৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে এবং মানবেতর পরিবেশে ক্যাম্পে বসবাস শুরু করে। তারপর কেটে গেছে ছয়টি বছর, কোনো বিচার ছাড়াই।

গণহত্যার অভিপ্রায় এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি হয়েছে, তবুও অপরাধীরা এখনও ধরাছোয়ার বাহিরে, এমনকি গত বছর মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল করে এমন একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে জান্তাবাহিনী। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় রোহিঙ্গাদের হতাশা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাংলাদেশে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বে গো হোম ক্যাম্পেইন বা ‘বাড়ি চলো’ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে যেখানে রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার দাবী ব্যক্ত করেছে রোহিঙ্গারা। সংকটের ৬ বছরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এইমুহূর্তে ‘প্রত্যাবাসন’ এবং ‘ন্যায়বিচার’ বাংলাদেশ এবং রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই মূল আলোচনার বিষয়। এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য ছাড়া, এইসময়ের ‘সবচেয়ে নির্যাতিত সম্প্রদায়ের’ এই মৌলিক মানবাধিকারগুলি অর্জন করার সম্ভাবনা খুবই কম।

কমে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা

গেল কয়েক বছরে ইউক্রেনের মতো বেশ কয়েকটি সংঘাত বিশ্বব্যাপী আবির্ভূত হওয়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগও রোহিঙ্গা সংকট থেকে সরে যাচ্ছে। গেল ৬ বছরে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রত্যাবাসন ও ন্যায়বিচারের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এটি জান্তাবাহিনীর অপরাধীদের গণতন্ত্র হরণ, গণহত্যার মত অপরাধ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।

২০১৯ সালের নভেম্বরে, গাম্বিয়া, ৫৭-জাতির অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) এর পক্ষে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক মামলা দায়ের করে, দেশটিকে জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন এবং শুনানি প্রক্রিয়া চলছে। তবে, তহবিলের ঘাটতির কারণে, গাম্বিয়াও মামলাটি চালিয়ে রাখতে বেশ বেগ পাচ্ছে।

আলাদাভাবে, আন্তররাজিতক অপরাধ আদালত (আইসিসি) নভেম্বর ২০১৯ সালে তখন ঘটে যাওয়া নৃশংসতার তদন্তের অনুমোদন দেয়। অন্যদিকে, আইসিজে ২২ জুলাই, ২০২২ সালে রায় দেয় যে মায়ানমারের প্রাথমিক আপত্তি সত্ত্বেও গণহত্যার জন্য গাম্বিয়ার মামলা চলবে। শিক্ষাবিদ এবং অধিকারকর্মীদের মতে, আইসিজে রায় রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার প্রদানের জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উপর চাপ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য নতুন সুযোগ উন্মুক্ত করেছে। তবুও, চূড়ান্ত রায় কয়েক বছর লাগতে পারে।

বিচারব্যবস্থা যখন ‘ঢিমেতালে’ এগোচ্ছে, তখন রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। গত দুই-তিন বছর ধরে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল ক্রমাগত কমছে। মানবিক সহায়তা হ্রাসের পাশাপাশি, সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলিও দাতাদের ক্লান্তি এবং তহবিল স্বল্পতার কারণে তাদের সহায়তা হ্রাস করছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এক বছরে দুইবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মাসিক রেশন কমিয়েছে। মার্চ ২০২৩-এ, সংস্থাটি ঘোষণা করেছে যে তারা মার্চের পর থেকে মাসিক বরাদ্দ বর্তমান ১২ ডলার থেকে ১০ ডলারে কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাস খানেক পরে আবার রেশন কমানোর ঘোষণা দেয়। বর্তমানে রোহিঙ্গারা প্রতি মাসে মাত্র ৮ ডলার পাচ্ছে।

সাহায্য হ্রাস শরণার্থীদের জন্য বিরূপ প্রভাব বয়ে আনবে। ইতিমধ্যেই ডব্লিউএফপি-এর রেশন কাটার আগেই, ৪৫ শতাংশ শরণার্থী সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে পারেনা। ৪০ শতাংশ শিশুর শারিরীক বৃদ্ধি স্থবির ছিল এবং ৪০ শতাংশ গর্ভবতী এবং স্তন্যপান করানো মায়েদের রক্তশূন্যতা ছিল। মাসিক রেশনের সর্বশেষ হ্রাস সংখ্যা এসব সমস্যাকে আরো বৃদ্ধি করবে। সাহায্যের ঘাটতির অর্থ হল আরও অপুষ্টি, আরও রোগ, কম পরিষেবা এবং ফলশ্রুতিতে শরণার্থীশিবিরে আইন শৃঙ্খলার অবণতি ঘটা। এতে বাল্যবিবাহ বাড়তে পারে কারণ বাবা-মা স্বল্প রেশনের কারণে তাদের পরিবারের সদস্য কমাতে বাধ্য হবে।

গো হোম ক্যাম্পেইন, পাইলট প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা, এবং পরাশক্তিদের রাজনীতি

ক্রমহ্রাসমান তহবিল, রেশন কাটা এবং শিবিরের অবনতিশীল অবস্থার মধ্যে, রোহিঙ্গারা তাদের পৈতৃক বাড়িতে প্রত্যাবাসনের দাবিতে একটি ‘গো হোম’ আন্দোলন বা বাড়ি চলো আন্দোলন করেছিল। গত আগস্টে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাচেলেটের সঙ্গে দেখা করার সময়ও তারা রাখাইনে ফিরে যাওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করে। তবে রোহিঙ্গাদের দাবির বিপরীতে জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলো সমাধান হিসেবে এই জনগোষ্ঠীকে একীভূতকরণ বা আত্তীকরণের পরামর্শ দিচ্ছে যা বাংলাদেশ বেশ ইতিমধ্যে কয়েকবার অস্বীকার করেছে। মনে হচ্ছে জাতিসংঘ এবং বিশ্ব সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশকে তাদের মানবিক দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার তাগিদে দ্রুত এবং সহজ সমাধান খুঁজছে, আমলে নিচ্ছে না যাদের নিয়ে এত কথা সেই রোহিঙ্গাদেরই।

সম্ভবত, গত বছরে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল পাইলট প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা যা বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার বর্তমানে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। চীন-সমর্থিত এই ‘পরীক্ষামূলক প্রকল্পের’ লক্ষ্য দ্বিপাক্ষিকভাবে রাখাইন রাজ্যে ১১৭৬ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা যা চীনের সহায়তায় করার চেষ্টা চলছে।

যাইহোক, ‘নিরাপদ ও উপযোগী’ পরিবেশ নিয়ে এই প্রকল্পটি পশ্চিমা দেশ এবং সংস্থাগুলির দ্বারা অত্যন্ত সমালোচিত হচ্ছে। যাইহোক, মনে হচ্ছে তাদের উদ্বেগ মূলত চীনের সাথে পশ্চিমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে এই প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততা নিয়ে।

শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তার অবনতি, তহবিল সংকট এবং বৈশ্বিক মনোযোগ হ্রাস রোহিঙ্গা সংকটকে দীর্ঘায়িত করছে। এটি ইতিমধ্যে ছয় বছর হয়ে গেছে এবং আরও অনেক বছর চলতে পারে। এই সম্প্রদায়কে প্রত্যাবাসনে বিশ্ব সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অধিকন্তু, রোহিঙ্গা জাতিসত্ত্বা সংরক্ষণ এবং শরণার্থীদের দাবি বিবেচনা করে আত্তীকরণ বা একীকরণ কোন টেকসই সমাধান হতে পারে না। অধিকন্তু, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ যা ১১ লাখ নতুন লোকের আত্তীকরণের সামর্থ্য রাখে না- সংখ্যাটি গোটা ভুটানের জনসংখ্যাথেকেও বেশি। আত্তীকরণ করা হলে, জাতিসত্ত্বা সময়ের সাথে সাথে ধ্বংস হবে। সুতরাং, রোহিঙ্গা দেশত্যাগের ষষ্ঠ বার্ষিকী পরেও, প্রত্যাবাসনই একমাত্র টেকসই সমাধান এবং বিশ্ব সম্প্রদায়কে তাদের ভূ-রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ একপাশে রেখে এই হতভাগ্য লোকদের তাদের পৈত্রিক বাড়িতে প্রত্যাবাসন করতে সচেষ্ট হতে হবে।

 

লেখক: নাজিফা নাওয়ার, কলামিস্ট ও গবেষক।