চলমান সংঘাত বন্ধে রাজনৈতিক সমাধানে আগ্রহী মিয়ানমার সরকার

:: ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন ::
প্রকাশ: ১২ মাস আগে

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে ব্রাদারহুড এলায়েন্সের চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে চলমান সমন্বিত আক্রমণে জান্তা বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকে সামরিক শাসনের জন্য এটিই ছিল সবচেয়ে বড় হুমকি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে মিয়ানমারে এক ডজনেরও বেশি জাতিগত সংখ্যালঘু সশস্ত্রগোষ্ঠী দেশের সীমান্ত অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সাথে বিভিন্ন সময়ে লড়াই করেছে। তবে তাদের মধ্যে ঐক্য ও বিশ্বাসের অভাব ছিল। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে তিনটি গোষ্ঠী একত্রে ব্রাদারহুড এলায়েন্স নামে উত্তর শান রাজ্য জুড়ে যৌথ আক্রমণ পরিচালনার মাধমে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা চীন সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি দখল করে।

পরবর্তীতে তারা সারা দেশ জুড়ে ঐক্যবদ্ধ আক্রমন চালায়। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পি ডি এফ) পূর্ব কায়াহ রাজ্যের রাজধানীর কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং শহর থেকে জান্তা সৈন্যদের উৎখাত করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মন রাজ্যের কিয়াইকমারা টাউনশিপে লড়াই অব্যাহত থাকায় ২০টিরও বেশি গ্রামের ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) এবং পিডিএফ বাগো অঞ্চলের কিয়াউকগি টাউনশিপের মোনে টাউনের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেএনইউ যোদ্ধারা পূর্ব কারেন রাজ্যের কাওকারিক শহরে সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমন চালায়। এই শহরটি ইয়াঙ্গুনের সাথে থাই সীমান্তের বাণিজ্য কেন্দ্র মায়াওয়াদিকে সংযুক্ত করে। সামরিক বাহিনী ও কেএনইউ’র মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা লড়াইয়ে ইয়াঙ্গুন ও মায়াওয়াদির মধ্যবর্তী এই এলাকা প্রতিনিয়ত অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকে। মায়াওয়াদি, থাইল্যান্ডের সঙ্গে মিয়ানমারের ছয়টি সরকারি সীমান্ত ক্রসিংগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ব্যস্ততম সীমান্ত বাণিজ্য কেন্দ্র।

কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ) এবং পিডিএফ বাগো অঞ্চলের কিয়াউক্কি টাউনশিপের মোনেতে একটি সামরিক চেকপয়েন্টে আক্রমণ করায় উভয় পক্ষই ব্যাপক হতাহতের শিকার হয়েছে এবং বিপুল সংখ্যক জান্তা সৈন্য প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মোন শহরটি জান্তার স্নায়ু কেন্দ্র, নেপিদো এবং কেএনইউ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমার-থাই সীমান্তের উভয় অঞ্চলে অবস্থিত। এই অবস্থানগুলি নেপিদোর কাছাকাছি, এবং কৌশলগতভাবে মিয়ানমার-থাই সীমান্তের রাস্তায় অবস্থিত।

চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী কোকাং স্বশাসিত অঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্র লাউক্কাইং শহর দখলের প্রস্তুতি হিসেবে জাতিগত কোকাং সশস্ত্র গোষ্ঠী  জান্তার ঘাঁটিতে আক্রমন চালায়। মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) সৈন্যরা ঘাঁটি দখলের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এমএনডিএএ পাঁচ দিন সংঘর্ষের পর কোকাং স্ব-শাসিত অঞ্চলের উত্তরে কনকিয়ান টাউনশিপ দখল করে নেয়। শহরটি ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জান্তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। এমএনডিএএ এবং মিত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলি শান রাজ্যের বিশেষ অঞ্চল ১ এর লাউক্কাইং টাউনের আশেপাশের ২০০ টিরও বেশি জান্তা ঘাঁটি এবং বেশ কয়েকটি কৌশলগত শহর দখল করে।

রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘর্ষের কারনে স্থানীয় বাসিন্দারা আতংকে রয়েছে। এর পাশাপাশি সেখানে খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাখাইনে জান্তার চলমান অবরোধের কারনে সব জিনিসের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে এবং রাজ্যের ৩০ লাখেরও বেশি মানুষের অধিকাংশই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকটে ভুগছে। সিটওয়ে-ইয়াঙ্গুন মহাসড়ক অবরুদ্ধ থাকায় পণ্যের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে।

জান্তার প্রধান মিন অং হ্লাইং বলেন যে, আরাকান আর্মির সৃষ্ট সংকটের কারনে রাজ্যের বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং ম্রাউক-ইউ, কিয়াউকতাও ও পালেতওয়া শহরে সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে।  রাখাইন রাজ্যের পাউকতাও, মিনবায়া, রাথেডং ও মংডু শহরে আরাকান আর্মি (এএ)  সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। গত মাসে রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ক্রমবর্ধমান আক্রমণের কারণে সরকার প্রায় ২০ টি শহর এবং ৩০৩ টিরও বেশি ফাঁড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। পুরো ব্যাটালিয়নসহ শত শত জান্তা সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। রাখাইন রাজ্যের এই সংকটের কারনে সীমান্তের এপাশে যেন কোন প্রভাব না পড়ে দিকে সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।

জান্তা সরকার বিপ্লবী বাহিনী এবং বেসামরিক জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর  ইয়াঙ্গুন এবং মান্দালয়ের অনেক বাসিন্দা বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করছে। পিডিএফ এবং ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ৪ নভেম্বর সাগাইং অঞ্চলের কাওলিন শহরটি দখল করে।  শহরটি ৩ ডিসেম্বর থেকে বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে কাজ শুরু করেছে, বাজারগুলিও পুনরায় খুলছে এবং শহরে শান্তি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী দশকের পর দশক ধরে জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর (ইএও) সাথে সংগ্রাম করে আসছিল। তবে এবারের মত পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা কখনও হয়নি। চলমান সেনাশাসনের শুরু থেকে মিয়ানমারের উপর পশ্চিমা চাপ অব্যাহত রয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ভারত মিয়ানমারকে নানাভাবে সমর্থন দিলেও এই পরিস্থিতি তাদের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন জনজীবনের উপর প্রভাব ফেলায় সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন কমে গেছে। অনেক বিশ্লেষক অপারেশন ১০২৭-এর সাফল্যের জন্য চীনের সমর্থন আছে বলে মনে করে,  অনেকের মতে বার্মা এক্টের কিছুটা প্রভাব এই সমন্বিত আক্রমনের সুযোগ করে দিয়েছে[1]। তবে যাই হোকনা কেন, এবারের সংগ্রামে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভামার জনগোষ্ঠীর সমর্থন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সামর্থ বাড়িয়েছে। দেশের মুল জনগোষ্ঠী ভামারদের সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন কমে যাওয়া এবং ভামার সংখ্যাগরিষ্ঠ সামরিক বাহিনীতে ভামার তরুনদের যোগদানে অনিচ্ছা এই পরিস্থিতির উপর বিরুপ প্রভাব ফেলেছে। তরুন ভামার যুবকদের  কাছে বহু বছর ধরে চলা সেনাশাসনের অবসান ও গনতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার  কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেটা নিভে গেলে তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠেও অনেকে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেয়।

মিয়ানমারজুড়ে একাধিক ফ্রন্টে ক্রমাগত সামরিক পরাজয়ের মধ্যে জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বেসামরিক জনগণের দুর্দশার জন্য দেশটির ইএও’কে দায়ী করেছে। মিয়ানমারের জনগণ ও তার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত বিপ্লবী বাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশে মিন অং হ্লাইং মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে জানায় যে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখলে স্থানীয় জনগণই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। জান্তা প্রধান এএ’কে রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য অভিযুক্ত এবং কারেনি ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টিকে (কেএনপিপি) সেখানে চলমান লড়াইয়ের সময় কায়াহ রাজ্যের রাজধানী লোইকাওতে অনেক বাড়িঘর এবং ভবন ধ্বংসের জন্য দায়ী করেছে। তিনি ইএওদের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার আহ্বান জানান। সরকার মিয়ানমারের পলাতক সৈন্যদের তাদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার জন্য উত্সাহিত করার জন্য একটি ঘোষণা দেয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পলাতকদের কাজে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে যে, দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব। তারা এমন কোন পদক্ষেপ সমর্থন করবে না যাতে জাতীয় সংহতির বিভাজন হবে এবং ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবে।

বিশ্লেষকদের মতে এই লড়াই অব্যাহত থাকবে, কারণ বিপ্লবী বাহিনী এখন মিয়ানমারে সামরিক একনায়কতন্ত্রকে নির্মূল করতে পুরোপুরি বদ্ধপরিকর। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, অক্টোবরে আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে বেসামরিক জনগনের হতাহতের পাশাপাশি দেশজুড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানা যায়। মিয়ানমারের জান্তা আয়ারওয়াদি ব্যতীত প্রতিটি রাজ্য ও অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই পিডিএফ এবং জাতিগত সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। চলমান এই সংঘর্ষের কারনে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে এবং অর্থ সংকটে থাকা জান্তা কর ও বৈদেশিক মুদ্রা রফতানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

চলমান এই সংঘাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থলযুদ্ধে পিছু হটছে। আক্রমনের মুখে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা শহরগুলোর পতন হচ্ছে। সীমান্ত বাণিজ্য সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে এবং দেশজুড়ে জনগণ আতংক, খাদ্যাভাব ও মূল্যস্ফীতির শিকার হচ্ছে। এন ইউ জি তাদের দখলে নেয়া শহর ও শহরতলীতে বেসামরিক প্রশাসন কার্যকরী করার চেষ্টা করছে। দেশজুড়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে হতাহত আর দুর্ভোগ। দমন পীড়নের মাধ্যমে সংঘাত নিরসন করতে না পেরে মিয়ানমার সরকার এতদিনে সংঘর্ষের পথ পরিহার করে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চিন্তা করছে।

এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং দেশজুড়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার আহ্বানে এখনও কেউ সাড়া দিয়েছে বলে জানা যায়নি, তবে মিয়ানমার জুড়ে সংগ্রাম চলমান রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক এটাই প্রত্যাশা।

[1] প্রাথমিক বিজয়ের দিকে মিয়ানমার বিপ্লব, টেট মিন লুইন ও থিহা উইন্ট অঙ, সমকাল, ২৬ নভেম্বর ২০২৩।

লেখক: ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল। মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।