ভুল চিকিৎসার অভিযোগে মামলা দায়ের করার দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নারী চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে আনা হয় ধানমন্ডি থানায়। এরপর দীর্ঘক্ষণ থানায় রেখে অন্য চিকিৎসকের জিম্মায় বাংলাদেশ আই হসপিটালে সারারাত রাখা হয় পুলিশ পাহারায়।
ঘটনাটি বুধবার দিবাগত রাতের।
পরে আজ বৃহস্পতিবার ওই চিকিৎসককে কোর্টে হাজির করা হলে তার জামিন আবেদন মঞ্জুর করা হয়।
ওই নারী চিকিৎসকের নাম ডা. শাহেদারা বেগম। তিনি ধানমন্ডিস্থ বাংলাদেশ আই হসপিটালের শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞ। গতকাল বুধবার রাত ১১টার দিকে তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ, গত মঙ্গলবার দেড় বছর বয়সী এক শিশুর চোখে তিনি ভুল অপারেশন করেছেন। শিশুর বাম চোখে সমস্যা অথচ ওই চিকিৎসক ডান চোখে অপারেশন করেছেন। কত ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে তা জানা যায়নি।
মামলা করার দুই ঘন্টার মধ্যে রাত একটার দিকে ধানমন্ডি থানা পুলিশ ওই নারী চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসেন। ধানমন্ডি থানার (ওসি তদন্ত) আব্দুল আলিম ও সঙ্গে থাকা এসআই খোকন সহ দুই গাড়ি পুলিশ প্রথমে যায় ওই চিকিৎসকের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়।
অভিযুক্ত চিকিৎসকের ছেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ড. রিয়াসাত নিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, আমাদের বাসার দারোয়ান সুরুজ মিয়া এতোগুলো পুলিশ দেখে প্রথমে ভয় পান। এরপর গেট খুলতে একটু বিলম্ব হলে পুলিশ দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। তারা জানতে চান চিকিৎসক শাহেদারা বেগম কোথায় আছেন?
ড. রিয়াসাত আরো বলেন, আমার আম্মু বাসাতেই ছিলেন। তিনি রুম থেকে বের হয়ে প্রথমে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে পুরো ঘটনা ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু পুলিশ উনাকে থানায় যেতে বলেন। ওসি সাহেব নাকি কথা বলবেন। আমরা পুলিশকে অনেক অনুরোধ করে বলেছি, সকালে থানায় যাই? কিন্তু তারা কোন কথা না শুনে তাদের পেট্রোল গাড়িতে করেই মাকে থানায় নেন। ধানমন্ডি থানায় এসে দেখি, ওসি সাহেব নেই। পর রাত সাড়ে তিনটার দিকে ওসি সাহেব এলে ডা. ইসতিয়াক সাহেবের জিম্মায় মাকে ধানমন্ডিস্থ বাংলাদেশ আই হাসপাতালে রাখা হয় পুলিশ পাহারায়। এখন আমরা পরিবারের অন্যান্য লোকজনসহ সেখানেই আছি। এখান থেকে হয়তো কোর্টে যেতে হবে আমাদেরকে।
যা জানা গেছে
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার দেড় বছর বয়সী শিশু ইরতিজা আরিজ হাসানের চোখে সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ আই হসপিটালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও স্ট্র্যাবিসমাস সার্জন ডা. শাহেদারা বেগমের শরণাপন্ন হন শিশুটির পিতা-মাতা। চিকিৎসক দেখেন চুল জাতীয় কিছু একটা চোখে লেপ্টে আছে যা ডান চোখের কর্নিয়ার উপর আঘাত করছে। এরপর তিনি হালকা এনেসথেশিয়া দিয়ে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে ফরেন বডি রিমুভ করেন অতি অল্প সময়ে। এরপর ব্যান্ডেজ করে দেন যেহেতু কর্নিয়ায় আঘাত পেয়েছে।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে এলে রোগীর অভিভাবক জানায়, শিশুর সমস্যা তো বাম চোখে, কিন্তু ডান চোখে ব্যান্ডেজ কেন? এরপর আবার ওটিতে নিয়ে দুই মিনিটের মাথায় বাম চোখের ময়লাও বের করা হয় একই প্রক্রিয়ায়। এই ঘটনার পর রোগীর লোকজন ও সাংবাদিক ডেকে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনেন।
শিশুর বাবা মাহমুদ হাসান বলেন, আমাদের সঙ্গে আজ এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটলো। কিন্তু এটা যদি বড় কোনো অপারেশন হতো তাহলে আমাদের হয়ত এখন ছেলেকে নিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দৌড়াদৌড়ি করতে হতো। এ ঘটনার সুষ্ঠু ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
শিশু আরিজের মা ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, আমার শিশুর বড় কিছু হয়ে গেলে কী তারা চোখ ফেরত দিতে পারত? আমরা এই চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সহ চিকিৎসা সংক্রান্ত লাইসেন্স বাতিল চাই।
অভিযুক্ত চিকিৎসক যা বললেন
গ্রেপ্তারের আগে বাংলাদেশ আই হসপিটালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শাহেদারা বেগমের কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি নিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ ভুল তথ্য প্রচার হয়েছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। শিশুর চোখে অপারেশন জাতীয় কোন কিছুই করা হয়নি। আমি সেদিন রোজা ছিলাম। শিশুটিকে আনা হয় চেম্বার শেষ হবার ঠিক আগে আগে। চোখ ঠিক মতো দেখতেই দিচ্ছিল না। অনেক কষ্টে ওর চোখের পাতা উল্টিয়ে দেখি, চুল জাতীয় কিছু একটা লেপ্টে আছে। সেখানে ঘর্ষণের দাগও দেখতে পাই। মূলত Foreign body & Corneal Abrasion এর জন্য বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছিল। আমি পরের দিনের পরিবর্তে তখনই ওটিতে নেই। ওর ডান চোখে ফরেন বডি দেখতে পেয়ে সেটা রিমুভ করি; যাকে বলে এক্সামিনেশন আন্ডার এনেসথেশিয়া। পরে শিশুর বাবা-মা জানান, সমস্যা বাম চোখে ছিল। তখন তাড়াতাড়ি তাওয়েল পেচিয়ে আবার ওটিতে নিয়ে বাম চোখের ফরেন বডিও রিমুভ করি ২ মিনিটের মধ্যেই। ঘর্ষণের জন্য একটা ব্যান্ডেজ দেই যা ২৪ ঘন্টা পর খুলে ফেলবে। ওর মূলত দুই চোখেই সমস্যা ছিলো। তবে কোন ধরণের অপারেশন করা হয়নি।
ডা. শাহেদারা বলেন, রোগীর অভিভাবক এটাকেই অনেক বড় ইস্যু বানিয়ে কিছু সাংবাদিক আর তাদের আত্মীয়-স্বজনকে ডেকে অভিযোগ দেয়। নিউজে এসেছে, আমি নাকি পালিয়ে গেছি! কিন্তু সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য। ৩০ বছর ধরে আমি সুনামের সঙ্গে শিশুদের চক্ষু চিকিৎসা করে আসছি, আলহামদুলিল্লাহ।আমি শেষ সময় পর্যন্ত সব বুঝিয়ে দিয়েছি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।