কোরিয়ায় মা-বাবারা কেন নিজেদের বন্দি রাখছেন?

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ৫ মাস আগে
প্রতীকী ছবি

হ্যাপিনেস ফ্যাক্টরির প্রতিটি কক্ষ থেকে বাইরের দুনিয়ায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম দরজার একটি ছিদ্র। কক্ষগুলোর ভেতর থেকে কোনো ফোন নেই, ল্যাপটপ নেই।

ঘরগুলো দোকানের আলমারির মতো। ভেতরে সঙ্গী কেবল চারদিকের দেয়াল।

এসব কক্ষের ভেতরে থাকা বাসিন্দারা কারাবন্দিদের মতো নীল রঙের ইউনিফর্ম পরিধান করেছেন। তবে তারা বন্দি নন। দক্ষিণ কোরিয়ায় হ্যাপিনেস সেন্টারের কক্ষগুলোতে লোকেরা আসেন বন্দিত্বের অভিজ্ঞতা নিতে।

সেন্টারে আসা লোকেদের বেশির ভাগেরই সন্তান রয়েছে। কিন্তু তারা সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হলে কেমন লাগে, সেই অভিজ্ঞতা নিতেই তারা এখানে আসেন।

নির্জন বন্দি-কক্ষ
নির্জন বন্দি-কক্ষে থাকা বাসিন্দাদের সন্তানদের মতো নিভৃত তরুণদের হিকিকোমোরি বলা হয়। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে শব্দটি জাপান থেকে আসে। কিশোর ও তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার আগ্রহকে বর্ণনা করতে শব্দটি ব্যবহৃত হতো।

গত বছর ১৯ থেকে ৩৪ বছর বয়সী ১৫ হাজার তরুণকে নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে দেখা যায়, ৫ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখছেন।

জরিপ অনুযায়ী পুরো দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন পরিস্থিতিতে থাকা তরুণদের সংখ্যা হবে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার।

এপ্রিল থেকে সন্তানদের বাবা-মায়েরা ১৩ সপ্তাহের লালনপালন শিক্ষাবিষয়ক এক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। কোরিয়া ইয়োথ ফাউন্ডেশন ও ব্লু হোয়েল রিকভারি সেন্টার এ কর্মসূচিতে অর্থায়ন করছে।

এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য হলো, সন্তানদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ আরও ভালো করা যায়, তা মা-বাবাকে শেখানো। এ কর্মসূচিতে তিন দিন নির্জন বন্দি-কক্ষে থাকার অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগ থাকছে, তারা সন্তানদের আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন।

মানসিক কারাগার
জিন ইয়ং- হায়ের ছেলে তিন বছর ধরে নিজের থাকার ঘরেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। বিচ্ছিন্ন থাকতে শুরু করার পর তিনি নিজের ২৪ বছর বয়সী ছেলের এ পরিস্থিতিকে মানসিক কারাগার বলে উল্লেখ করেন।

৫০ বছর বয়সী এ নারী বলেন, আমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম, কী ভুল করলাম… এ নিয়ে ভাবনাটাও কষ্টদায়ক। তবে যখন ভাবতে শুরু করি, তখন কিছুটা স্পষ্ট হই।

কথা বলতে অনীহা
জিন বলেন, তার ছেলে সবসময়ই মেধাবী। ছেলের ওপর মা-বাবার আশা ছিল বেশি।

কিন্তু ছেলে প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। বন্ধুত্ব রক্ষায় তাকে বেগ পোহাতে হচ্ছিল। তার মধ্যে খাওয়ার রোগও দেখা দেয়। এসবের কারণে তার স্কুলে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছিল।

ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর থেকে তার মনে হচ্ছিল, ভালোই করবেন। কিন্তু একদিন হঠাৎই সব পাল্টে গেল।

ছেলে নিজেকে বন্দি রাখতে শুরু করলেন। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও খাবারে অনীহা মায়ের হৃদয় ভেঙে দিল।

দুশ্চিন্তা, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কে সমস্যা এবং শীর্ষ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সফল না হওয়া- এসব ঘিরে ধরলেও ছেলের তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে অনীহা দেখা যায়, যা ভুল।

জিন যখন হ্যাপিনেস ফ্যাক্টরিতে আসেন, তিনি অন্য একাকীদের লেখা পড়তে শুরু করেন। এসব লেখা তাকে অনুভব করতে শেখায়, বুঝতে শেখায়। তিনি বুঝতে পারেন, ছেলে নীরবে থাকতে চায়, কারণ কেউ তাকে বুঝতে পারেন না।

পার্ক হান-সিল (ছদ্মনাম) হ্যাপিনেস সেন্টারে এসেছেন তার ২৬ বছর বয়সী ছেলের জন্য, যিনি সাত বছর আগে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। কদাচিৎ তিনি ঘর থেকে বের হন।

পার্ক ছেলেকে নিয়ে কাউন্সেলরের কাছে গিয়েছেন, ডাক্তার দেখিয়েছেন। কিন্তু ছেলে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ভিডিও গেম খেলতে খেলতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।

ব্যক্তি-ব্যক্তি সম্পর্ক
বিচ্ছিন্ন থাকার মাধ্যমে পার্কের ছেলের অনুভূতি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছেন। তিনি বলেন, আমি বুঝতে পেরেছি, সন্তানকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে থাকতে বাধ্য না করে তার ইচ্ছে মেনে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা থেকে দেখা যায়, তরুণদের নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার বেশ কিছু কারণ রয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের জরিপ থেকে দেখা যায়, ১৯ থেকে ৩৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের বিচ্ছিন্ন থাকার মনোভাবের পেছনে সাধারণ কারণগুলো হলো চাকরি না পাওয়া, আন্তঃব্যক্তি সম্পর্ক নিয়ে সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা ও স্বাস্থ্য সমস্য।

দক্ষিণ কোরিয়ায় গত বছর আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি ছিল। দেশটির সরকার এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা উন্মোচন করেছে।

মন্ত্রীরা ঘোষণা দিয়েছেন, প্রতি দুই বছর অন্তর ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের রাষ্ট্রীয় খরচে মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে।

১৯৯০-এর দশকে জাপানে তরুণ-তরুণীদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঢেউ প্রথমবার দেখা যায়। এতে মধ্যবয়সী লোকেদের মা-বাবার ওপর নির্ভরশীলদের সংখ্যা বেড়ে যায়। মা-বাবারা তাদের পেনশন থেকে পূর্ণবয়স্ক সন্তানদের সাহায্য করতে গিয়ে দারিদ্র্য ও দুশ্চিন্তায় পড়েন।

কিয়ং হি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গো-উন বলেন, কোরীয় সমাজ চায়, সন্তানেরা নির্দিষ্ট সময়েই তাদের জীবনের বড় গন্তব্যে যাক। এতে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়, বিশেষ করে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার সময়ে।

সন্তানের সাফল্য মা-বাবার সাফল্য, এমন দৃষ্টিভঙ্গি পুরো পরিবারকে বিচ্ছিন্নতায় ডুবিয়ে দেয়। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানের ব্যর্থতাকে লালন-পালনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখেন, যা তাদের অপরাধবোধের দিকে পরিচালিত করে।

অধ্যাপক জিয়ং বলেন, কোরিয়ায় মা-বাবারা সাধারণত ভালোবাসা ও অনুভূতি কথার চেয়ে কাজের মাধ্যমেই বেশি প্রকাশ করে থাকেন। অভিভাবকেরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ যোগান, যা কনফুসিয়ান সংস্কৃতির এক সাধারণ উদাহরণ। এটি দায়িত্বের ওপর জোর দেয়।

কঠোর পরিশ্রমে জোর দেওয়ার চর্চা গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে দক্ষিণ কোরিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে, ওই সময়ই দেশটি বিশ্বে বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে ওঠে।

বিশ্ব অসমতা ডাটাবেজ অনুযায়ী, দেশটিতে সম্পদের অসমতা গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বাজে পর্যায়ে রয়েছে।

ব্লু হোয়েল রিকভারি সেন্টারের পরিচালক কিম ওকে-রান বলেন, তরুণ-তরুণীদের নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার দৃষ্টিভঙ্গি একটি পারিবারিক সমস্যা। এর অর্থ হলো অনেক মা-বাবা তাদের আশপাশের লোক থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।

অনেকে ভয়ে নিজের পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিবারের কাছের মানুষকেও বলতে পারেন না।

কিম বলেন, তারা সমস্যাটিকে সামনে আনতে পারেন না। এতে মা-বাবারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেন। ছুটির দিনেও তারা পারিবারিক জমায়েত এড়িয়ে চলেন।

খেয়াল রাখা
হ্যাপিনেস ফ্যাক্টরিতে সাহায্যের জন্য আসা লোকেরা অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন, তাদের সন্তানেরা স্বাভাবিক জীবন শুরু করবেন এমনটি দেখবেন।

ছেলে বিচ্ছিন্ন জীবন থেকে বেরিয়ে এলে তাকে কী বলবেন, এমন প্রশ্নে জিনের চোখ কান্নায় ভিজে আসে।

ছেলেকে তিনি বলবেন, তুমি অনেক বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এটি বেশ কঠিন ছিল। ছিল না? আমি তোমার খেয়াল রাখব।