শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড কথাটা মেলা শুনেছি শুনেছি আরো এই মেরুদণ্ডের জোরেই নাকি মানুষের প্রজাতিটা সৃষ্টির সেরা।কথিত আছে এই মেরুদণ্ডের জন্যই নাকি হাঁটা চলা, বসতে পারা খুব সহজ হয়েছে মানুষের।আচ্ছা এই মেরুদণ্ডটা যদি না থাকতো তাহলে একবার ভেবে দেখুন শ্রেষ্ঠত্বের দাবী আদায়ে আমাদের বেগ পেতে হতো হবেই না কেন আমরাতো তখন সোজা হয়েই দাঁড়াতে পারতাম না, যেমন এখনকার মানুষেরা বলে মাথা তুলে দাঁড়ানো এই আরকি। তাহলে বুঝুন মেরুদণ্ডের দাম কত?
কেমন হতে পারে একবার চিন্তা করে দেখুন, আচ্ছা কেউ যদি বলে আপনার শিরদাঁড়া (মেরুদণ্ড) আমাকে দিন বিনিময়ে যা টাকা চান দিতে দিবো, তখন নিবোর্ধ মানুষেরের উত্তরও হবে না মশায় এই আবদারটা রাখতে পারলাম না।মশায় রাগ করলেও তো করার কিছু নেই আমি আমার মেরুদণ্ড দিবো কেন? সোজা হয়ে চলার অধিকার খুইয়ে কেমন করে বাঁচা, শ্রেষ্ঠত্বের দাবিটা ছাড়া কি যৌক্তিক। রাগ বা ভয়ের সামনে পড়েও তো অধিকার ছাড়বো না, তাহলে জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষার ক্ষেত্রে এত উদাসীন কেন? মেরুদণ্ডের কথা বলার কারণ এই খানে নিহিত কেন আমরা উদাসীন? কেন না জানার ভান করে আছি? উত্তরটা শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হবে স্বার্থ আমাদের শিক্ষা নামক জাতির মেরুদণ্ড বেঁচতে লোভী করে তুলেছে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, আমরা জানি শিক্ষা হলো যা আমাদের চরিত্রকে পরিবর্তন করে আমাদের ব্যক্তিত্বকে শাণিত করে, বিবেকবোধ, বিচারবুদ্ধির সঞ্চার করে তাই। শিক্ষার মাধ্যমে জাতি তার স্বরূপ উন্মোচন করতে পারে, শিক্ষাই জাতিকে আলোকিত করতে পারে। শিক্ষার বদৌলতে মানুষ তার বিবেকবোধকে জাগাতে পারে, শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মননে নতুনত্বের আমেজ তৈরি হয়। শিক্ষা মানুষের মানবিকতার দ্বার উন্মোচিত করার মাধ্যমে তাকে জগতের বুকে পরিচিত করিয়ে দেয়। এই সব গুণাবলির জন্য শিক্ষাকে একটি জাতির মেরুদণ্ডের সাথে তুলনা করা হয়, তাই পাঠ্যবইয়ে সুন্দর করে উপস্থাপন করা হয় শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হিসাবে।
বর্তমানে আমাদের অবস্থা:
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে মনে হয় আমাদের মেরুদণ্ড খুবই সস্তা দামে বিক্রি করে দিচ্ছি, দূর্বলতা ঢাকতে গিয়ে নিজেদের দৈন্য দশার পরিচয় দিচ্ছি প্রতিনিয়ত।ভুরি ভুরি তথাকথিত ভালো ফলাফল করলেও শিক্ষার জরাজীর্ণ অবস্থা সর্বত্র বিরাজমান। শিক্ষার্থী ও বিদ্যা বিতরণকারীদের মধ্যে বিরাট দূরত্ব বিরাজ করছে, নীতিহীন শিক্ষার্থী নামক অমানুষের হাতে বলি হতে হচ্ছে শিক্ষককে। এই লজ্জায় আমরা আজ লজ্জিত না তো, দেদারসে খুলে বসেছি বিদ্যাপীঠ, অলিতে-গলিতে হরেক রকমের বিদ্যা বিতরণের ব্যবস্থায় খোলা প্রতিষ্ঠান গুলোই মেরুদণ্ড বিক্রির নিলাম নিয়েছে। চাটুকারিতা, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ধ্বংস করে দিচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা।
কেন আমাদের আদরের সন্তানরা ভালোত্বের সংস্পর্শে আসছে না? কেন উচ্চহারে কথিত ভালো ফলাফল করেও বিবেকবান মানুষ হচ্ছে না? নৈতিকতা চর্চার পাঠশালায় কেন বখাটেপনা?
এমন হাজারটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারবেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারবেন শত শত ভুল, তবুও যেন নীতিনির্ধারকদের হুঁশ হয় না হবেও না। এমন আদর্শ বর্জিত শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের দোষ গুলো একটু বের করি, তবেই না হয় বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো কোমলমতি শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষকদের স্বার্থন্বেষী চিন্তা:
প্রথমেই বলে নিচ্ছি আমি সকল শিক্ষকদের একপাল্লায় ওজন করতে বসেনি, সবাইকে স্বার্থন্বেষীও বলার সাহস করছি না, তবে কতক নাম বিচারে শিক্ষকদের সম্পর্কে না বললে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
তাই, বলতে বাধ্য হচ্ছি-
আমি এমন দেখেছি প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের চমকপ্রদ উপহারের বিনিময়ে শিক্ষক ছাত্রদের হাতে তুলে দিচ্ছেন মানহীন প্রকাশনীর সহায়ক গাইড বই( যা আমাদের কথিত নিয়মে নিষিদ্ধকরণ করা হয়েছে) গাইড কেনার জন্য শিক্ষকের কড়াকড়ির নজর এড়ায়নি হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের।ধারকর্জ করে গাইড নামক সহায়ক বই কিনতে বাধ্য হচ্ছে পরিবারগুলো।
আর যে খারাপ কাজটি দেখলাম শিক্ষার্থীদের বাৎসরিক পাঠ্য কার্যক্রমের সিলেবাসে গাইড কোম্পানির নাম ও পৃষ্ঠা নাম্বার সংযুক্ত করে দেওয়ার মতো নিন্দনীয় কাজ গুলো তথাকথিত শিক্ষকরাই করছে। মানলাম শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন সহজ করার জন্য আপনি গাইড নির্ধারণ করে দিলেন ভালো কথা তবে, আপনি কিভাবে সকল ছাত্রের মেধার বিচার করলেন? কিভাবে বুঝলেন সবাই একই মানের লেখা আত্তীকরণ করতে পারবেন?
না, আপনার কাছে তার জবাব নেই।আপনি কিছু বলার সৎ সাহসও রাখছেন না কারণ আগেইতো বলা আছে আপনারা আমাদের মেরুদণ্ড বিক্রির পসরা সাজিয়ে বসে আছেন তার জন্য নয়কি।
অদূরদর্শী চিন্তা:
পরীক্ষা নামক প্রত্যয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মান বিচার করা হয় জানি।তবে, পরীক্ষা নামক প্রত্যয়ে যদি আপনি যাচ্ছেতাই করে বসেন তখন মানের বিচার করবেন কিভাবে? এক আজব পরীক্ষা পদ্ধতি দেখছি বর্তমানের কতক বিদ্যাবিতরণ কেন্দ্রে। আপনি শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিচ্ছেন ভালো কথা, তাই বলে আগে প্রশ্ন বলে দিবেন? শর্ট সিলেবাসের নামে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে দিচ্ছেন আপনি কিসের মাধ্যমে তাকে বিচার করবেন! আপনিই বলেন এটা কি সমীচীন আপনার জন্য, না আপনার উত্তরে লুকিয়ে থাকবে নানা চল-চাতুরী। আপনারা আমাদের চিন্তা বিবেকবোধকে মেরে ফেলছেন তথাকথিত বিদ্যা বিতরণের নামে।
স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার:
আপনি সকল শিক্ষার্থীকে আপন ভাবতে পারছেন কোথায়? আপনার কাছে টিউশন নেওয়া ছাত্রটা যদি আপনার থেকে অতিরিক্ত সুবিধা পায় তাহলে সমতার যে নিক্তি আপনার হাতে সেটা দিয়ে তা পরিমাপ করবেন কেমন করে? ক্লাসে তার প্রতি অতিরিক্ত খাতির অন্যদের চোখ এড়াবেন কেমন করে, কেমন করে জানান দিবেন আপনি সৎ ও নিষ্ঠাবান!
প্রশ্ন আপনার কাছে রাখলে উত্তর আশা করা বোকামির সামিল। তাই, আর উত্তর খুঁজবো না।
উত্তাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান:
পান থেকে চুন খসলেই মারামারি বাধিয়ে ফেলার যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে প্রতিযোগিতা চলছে, কে কার আগে এমন ভয়াবহ তাণ্ডব চালাতে পারবে তার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ক্যাম্পাস ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নানা সংঘাতে ব্যহত হচ্ছে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম। জুনিয়র ছেলেদের বড় ভাইদের সাহচর্য বিষিয়ে তুলছে শিক্ষার পরিবেশ।
শুধু ব্যথিত বুকের আহাজারি শুনাতে পারি তাই দ্বিধাহীনভাবে বলছি, আমাদের বর্তমানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা তা আমাদের সুন্দর আগামীকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের নীতি-নৈতিকতার স্থানকে।এই ক্ষতি শুধু আমাদের আগামী প্রজন্মের নয় এই ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত।কারণ, আপনাদের বানানো নীতিকে পূঁজি করে তারাওতো একদিন বিদ্যার পসরা নিয়ে বসবে খদ্দরের আশায়। বড়ই আফসোস লাগে এমন শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে কি হবে যে শিক্ষা ব্যবস্থা মানহীন উচ্চ ফলাফল দিচ্ছে, দিচ্ছে একঝাঁক হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থী সমাজ।
এমন চলতে থাকলে আমাদের মেরুদণ্ড হারিয়ে আমরা অসহায় এক জাতিতে পরিণত হবো।
তাই, সুন্দর আগামীর কথা চিন্তা করে আমাদের উচিত-
দূরদর্শী চিন্তা করা, বুদ্ধিভিত্তিক পাঠদান, স্বার্থহীন বিচার, শিক্ষার্থীদের মননশীল শিক্ষার ব্যবস্থা এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আদর্শিক মানদণ্ডের বিধান।
তবেই আমরা ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারবো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে। সুন্দরে, কল্যাণে, আনন্দে আবারো উন্মোচিত হবে আমাদের শিক্ষার দ্বার। সম্মিলিত চিৎকারে বলতে পারবো শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড।
লেখক: আহমেদ হানিফ; শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।