মেধা আর দেশে প্রেমের ভিত্তিতে গঠিত মানব সম্পদ একটি জাতিকে আত্মপ্রত্যয়ী সুদৃঢ় ও উন্নত জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে অধিক সহায়তা করে। দেশপ্রেমহীন মেধা আর মেধা বিহীন দেশপ্রেম একটি জাতিকে তার অভিষ্ট্য লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারেনা। দেশপ্রেম, যুগোপযোগী শিক্ষা, উন্নত প্রশিক্ষণ, সততা ন্যায় নিষ্ঠা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোধ, মানবাধিকার নিশ্চিতের মধ্যদিয়ে একটি মেধাভিত্তিক উদার আধুনিক জাতি গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে চাকুরী প্রার্থী শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন, কোটা বিরোধী আন্দোলন, কোটা বাতিল আন্দোলন বেশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদলে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কোটা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সমান সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্য। সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদেও অনগ্রসর ও পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর কর্মে সমতা লাভের অধিকার নিশ্চিত করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে জাতির পিতাকে হত্যার পর সংবিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হয়নি। সামরিক শাসনের রোষানলে পড়ে দেশ উল্টোরথে যাত্রা করেছিল।
কর্ম কমিশনের তথ্য মতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারী চাকুরীতে মোক্তিযোদ্ধা-৩০%, নারী-১০%, জেলা-১০%,উপজাতি-৫%, ও প্রতিবন্ধী কোটায়-১% নিয়োগের বিধান রয়েছে। যা কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালে সরকারী পরিপত্র জারির মাধ্যমে বাতিল করে। সম্প্রতি হাইকোর্ট সেই পরিপত্র বাতিল করলে শুরু হয় কোটা বিরোধী আন্দোলন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায় মুক্তি যোদ্ধা ও নারী কোটায় কয়েকটি বিসিএসে ৮-৯% এর বেশী উত্তীর্ণ হতে পারেনি যা মেধায় পূরণ করা হয়। এর অর্থ এই নয় যে কোটায় অংশগ্রহণকারীরা মেধাবী নয় বরং তাদেরও সবার সাথে প্রিলি রিটেন পাশ করেই ভাইভায় আসতে হয়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের দাবি আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে যতটা প্রাধান্য দেয় তার বাইরে ৭৫-১৯৯৬ ও ২০০১-৯ সময়ে গত ৩০বছর সামরিক শাসক, বিএনপি ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন ছিল। ফলে অনগ্রসর কিংবা মুক্তিযুদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মান থেকে তারা বঞ্চিত হয় যা আজকের বেকারত্বের বাজারে তরুণদেরকে ভুল বুঝিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। মুক্তি যুদ্ধের চেতনার মূল কথা ছিল সাম্যের বাংলাদেশ কিন্তু সামরিক সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণে তা বেহাত হয়ে যায়। যারা জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করলো প্রাণ বিসর্জন দিল তারা হয়ে গেল অপরাধী, ফাঁসির আসামী, সমাজের নিম্ন শ্রেণী, দরিদ্র শ্রেণী। আর স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদররা হয়ে গেল দেশের প্রধান মন্ত্রী(শাহ আজিজ) মন্ত্রী(নিজামী,মুজাহিদ) যা তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে দেয়নি একটি চক্র। তাই তাদের দিয়েই ২০১৩ থেকে ২০১৮, ২০২৪ যখনই কোটা বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে তখনই মুক্তি যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলা হয়েছে। যখনই কোটা বাতিল আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে তখনই মুক্তিযুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে খাটো করে দেখা হয়েছে বা দেখানো হয়েছে। সময় এসেছে এসব আন্দোলনের যৌক্তিকতা খুঁজে দেখবার, অথচ আমরা ভুলে যাই মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এ স্বাধীন বাংলাদেশ।
কোটার প্রয়োজন কেন এখনো শেষ হয়ে যায়নি- রিপাবলিকানদের নীতি আদর্শ যেমন ডেমোক্রেটদের দিয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় তেমনি ডেমোক্রেটদেরে নীতি আদর্শ রিপাবলিকানদের সাথে এক রকম হবে না। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নও স্বাধীনতা বিরোধীদের দিয়ে সম্ভব না। এ ব্যপারে ঐতিহাসিক একটি তথ্য যুক্ত করতে চাই- স্বাধীন দেশের ‘আমলাতন্ত্র’ কেমন হবে তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সতর্ক করেছিলেন কিউবার অবিসংবাদিত বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। ১৯৭৩ সালে আফ্রিকার আলজিয়ার্স নগরীতে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের শেষপর্যায়ে এই দুই মহান নেতার সৌজন্য সাক্ষাতের বর্ণনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। যা এম আর আখতার মুকুল তার ‘মুজিবের রক্ত লাল’ বইতে মুজিব-কাস্ত্রোর কথোপকথন অংশে তুলে ধরেন। ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চান স্বাধীন দেশের আমলাতন্ত্র কিভাবে সাজিয়েছেন? উত্তরে বঙ্গবন্ধু জানান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমাদের মেধাবী ও অভিজ্ঞ আমলাদের দিয়ে প্রশাসন সাজিয়েছি। ফিদেল কাস্ত্রো অবাক হলেন এবং বল্লেন ‘‘উইথ দেয়ার এক্সপিরিয়েন্স অ্যান্ড অ্যাডভাইস মাইটি পাকিস্তান লস্ট ইন দ্য ওয়ার। ইয়োর মুক্তি বয়েজ?’’ নো এক্সপিরিয়েন্স। ফাইটিং, ফাইটিং অ্যান্ড ফাইটিং, গট ভিকটরি। কাস্ত্রো আরো বলেন- মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ভুলের পর ভুল করে সঠিক শিক্ষা লাভ করবে, কিন্তু এরা ষড়যন্ত্র করবে না। পরম করুণাময়ের দোহাই দিয়ে বলছি, আপনার মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের আরও বেশি করে দায়িত্ব দিন এবং সম্পূর্ণভাবে ওদের বিশ্বাস করুন। অন্যথায় আপনি কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন। তাঁর কথার ঐতিহাসিক সত্যতা আর নির্মম বাস্তবতা আমরা ইতোমধ্যে অতিক্রম করেছি। তাই বাস্তবতার আলোকেও আমাদের চিন্তা করতে হবে।
সম অধিকার, মানবিক মর্যাদা, বৈষম্যহীনতা বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসহ সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা থেকে শুরু করে অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলাদির মূল মতবাদ ও বিধান হিসেবে স্বীকৃত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে এবং বৈষম্যকেও নিষিদ্ধ করেছে। সংবিধানের ১৯, ২৭,২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে সমতা, সমান সুযোগ এবং বৈষম্য বিরোধী বিধানাবলী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ২৭ অনুচ্ছেদে সাধারণ অর্থে সমতা এবং ২৮(১) অনুচ্ছেদে বিশেষভাবে সমতার প্রয়োগকে বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে ধর্ম, গোষ্ঠি, বর্ণ, নারীপুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে বৈষম্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ। ২৯(১) অনুচ্ছেদে কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকলের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালে স্বাধীনতা বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধাদের সাথে আরো একবার পরাজিত হলে তার শোধ নেয় তরুণ ছাত্রনেতাদের রাস্তায় নামিয়ে গণজাগরণের বিপরীতে গণঅধিকার পরিষদ তৈরী করে যারা শুধু কোটা বিরোধী আন্দোলনই করেনি তারা মুক্তিযুদ্ধ কোটার সরাসরি বিরোধীতা করে। যার নেতারা পরবর্তীতে স্বাধীনতা বিরোধীদের দলে ভিড়ে যায় স্বাধীনতার শক্তিকে বিনাশ করতে হাত মেলায় বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাথেও। তাই এ কোটা বিরোধী আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী একটি সেন্টিমেন্ট তৈরীতেও ভূমিকা রাখছে বলে মনে হয়।
পরিশেষে বলবো মুক্তিযোদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। তাই মুক্তিযুদ্ধের নীতি আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মান ব্যতীত এ রাষ্ট্র সঠিক পথ খোঁজে পাবেনা। যারা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েছে তারা এখনো বিভিন্ন ভাবে স্বাধীনতার স্বপ্নকে নস্যাৎ করতে নানান ভাবে ফিরে আসে তাই তাদের মন্ত্রনায় তরুণ প্রজন্ম যেন বিভ্রান্ত না হয়।
লেখক: তানজিব রহমান, লেখক ও গবেষক।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]