কিভাবে এলো ‘বর্ণবাদ’, আমাদের অবস্থান কোথায়!

::
প্রকাশ: ২ years ago

পাবলিক রিঅ্যাকশন রিপোর্ট: 
গাত্রবর্ণের ভিন্নতার কারণে কোনো জনগোষ্ঠী সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যমূলক আচরণ করাকে বর্ণবাদ বলে। বর্ণবাদ মানেই বর্ণবৈষম্য। সাদা কালোয় ভেদাভেদ। হাল জমানায় এসে এই বর্ণবাদ কেবল গাত্রবর্ণের বৈষম্যের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং জাতি-গোষ্ঠী, দেশ-শ্রেণী এমনকি ধর্ম বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেও ‘বর্ণবাদ’ পরিলক্ষিত হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে আন্দোলন হয়েছে। আইন হয়েছে। হয়েছে নীতিমালাও। এমনটি গঠিত হয়েছে বিভিন্ন সংগঠন-কমিশনও। কিন্তু কেন থামছে না এই বৈষম্যপনা? কেন মানুষ মেনে নিচ্ছে না জন্মগত ভিন্নতার এই আবরণকে?

বর্ণবাদ বা আপার্টহাইট। আফ্রিকান ভাষায় এর অর্থ হল ‘বিভাজন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতা’। এটি দক্ষিণ আফ্রিকা আর দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকাতে নব্বইের দশক পর্যন্ত চলা জাতিগত বিভাজনের একটি ব্যবস্থা। তৎকালীন শ্বেতাঙ্গ শাসিত সরকার আইন করে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসীদের কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ, দক্ষিণ এশীয়, বর্ণসংকর ইত্যাদি বর্ণে ভাগ করে। এভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী মূল ধারার সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর আধিপত্য বিস্তার করে।

১৯৩০ সালে প্রথম বর্ণবাদ শব্দের উৎপত্তি হয়। চল্লিশের দশকের শুরু থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক স্লোগানে এর ব্যবহার শুরু করে। তবে শব্দটির সাথে জড়িত নীতির উদ্ভব আরও আগে। ১৬৫২ সালে আফ্রিকাতে শ্বেতাঙ্গ মানুষের বসতি স্থাপন শুরুর থেকে এই নীতির প্রচলন শুরু হয়। ঐ সময় ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ আফ্রিকায় কেপ কলোনি স্থাপন করেছিল। ১৭৯৫ সালে ব্রিটিশরা কেপ কলোনি দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রা বিরতির বিশ্রাম ও দাস ব্যবসার উদ্দেশ্যে এ এলাকা দখল করে। এবং এভাবে পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনে উৎসাহী হয়।

১৮৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার খনিতে হীরে ও ১৮৮৪ সালে স্বর্ণ পাওয়া যায়। এসব মূল্যবান সম্পদের সন্ধানে বহিরাগতর উপস্থিতি বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী, ব্রিটিশ শাসক শ্রেণি ও ডাচ-বুয়রদের মধ্যে ত্রিমূখি লড়াই আরম্ভ হয়। এভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। যেমনঃ সাদাদের রাজনৈতিক দল হল ‘ন্যাশনাল পার্টি’, আর কালোদের ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’। ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে সাদাদের ন্যাশনাল পার্টি জয়ী হয়। শ্বেতঙ্গ শাসক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে অশেতাঙ্গদের। এর ফলে যে নীতি নিতে হয়-তাই ‘আপার্টহাইট’ বা বর্ণবৈষম্য নীতি। সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাদা, কালো, বর্ণময় বা কালারড ও ইন্ডিয়ান-এই চার ভাগে ভাগ করে ফেলা হল। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার সে সময় একটি আইন প্রণয়ন করেছিল। এটি তখন ‘পাসপত্র আইন’ নামে পরিচিত। আইনে বলা হয়, কৃষ্ণাঙ্গদের সব সময় তাদের পরিচয় সংক্রান্ত নথিপত্র বহন করতে হবে।

বর্ণবাদ সম্পর্কে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলছে, এটা একটা বিশ্বাস। বর্ণবাদের মাধ্যমে পৃথিবীর জাতিগুলোকে বিভাজিত বর্ণের আলোকে দেখা হয়। বল্লাল সেনের বর্ণপ্রথার মতো। আর এর মাধ্যমে কোন একটি গোষ্ঠীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য, নৈতিকতা, সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিন্নতাকে ভালো ও উন্নত বিবেচনা করা হয়। যেমন; আমরা ইউরোপের অনেক ধারণাকে এখন শ্রেষ্ঠ হিসেবে মেনে নিয়ে অনুকরণের চেষ্টা করছি। নিশ্চিত নই এর জন্য আমাদের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু দায়ী।

আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বের ইতিহাসের সঙ্গে বর্ণবাদের সম্পর্ক নিবিড়। ঔপনিবেশিককালের জ্ঞানকাণ্ড, বিশেষত জীববিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান চর্চার একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল বর্ণবাদের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবিত করা। এমনকি সাহিত্যকর্মে আমাদের দেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের মধ্যে কাউকে কাউকে ঔপেনিবেশিক জ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করে নিতে দেখেছি। আবার গান্ধিজী বর্ণবাদের শিকার হয়েই ভারতে ফিরে এসে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন।

ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে বর্ণবাদ ন্যূনতম গত পাঁচ শতাব্দী ধরে পশ্চিমা বিশ্বের সামাজিক বিজ্ঞানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যদিও নিকট অতীতে বর্ণবাদ দাসপ্রথার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল কিন্তু পরবর্তী কাল প্রবাহে এটি আর দাস ব্যবসা ও প্রথায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। আমেরিকা ও ইউরোপে দাসপ্রথা উঠে গেলেও বর্ণবাদ রয়ে যায় কালো বা ইউরোপিয়ান সাদা নন এমন নাগরিকদের প্রতি নানা ধরনের বঞ্চনা ও বৈষম্য আরোপের মধ্য দিয়ে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের নাগরিক অধিকার আন্দোলন এই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ।

এর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বর্ণবাদকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে ঔপেনিবেশিক সমর্থক সমাজবিজ্ঞানীরা। এ সময় তারা সমাজ বির্বতনের একরৈখিক তত্ত্ব প্রচার করতে লাগলেন। এই তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে প্রত্যেকটি জাতি ও সংস্কৃতি উন্নতির কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করে নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছে। বলাবাহুল্য, তাদের এই তত্ত্বমতে ইউরোপিয়ানরা সেই স্তরে পৌছে গেছে— তাই অন্যদের শাসন করার অধিকার তাদের আছে।

 

বর্ণবাদ এবং আমাদের অবস্থান: 
ঔপনিবেশিকতা আনুষ্ঠানিকভাবে চলে গেলেও এর অনেক রূপান্তর রয়ে গেছে আমাদের সমাজে। বর্ণবাদ এরই একটা রূপ। বর্তমানে বর্ণবাদী আচরণ শুধুমাত্র উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। এর প্রকোপ ও বিস্তার সারা পৃথিবী জুড়েই বিস্তৃত। আমরা যদি আমাদের দেশের দিকে তাকাই তাহলেও দেখব বর্ণবাদের প্রকাশ ঘটছে নানাভাবে। এখানে অনেককেই দেখি নিজেদেরকে অন্যদের তুলনায় একটু আলাদা দেখেন বা জাহির করেন। কেউ করেন জ্ঞান গরিমার নামে, কেউ করেন পদ-পদবির জোরে, আবার কেউ করেন সম্পদের নামে, আরও কত কী? আমাদের প্রাত্যহিক আলাপচারিতায় ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটির ব্যবহার করি যার মাধ্যমে কোন একটি গোষ্ঠীর অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়াকেই বোঝাই।

তাই ইউরোপ ও আমেরিকায় বর্ণবাদী আচরণ দেখে খুশি হওয়া বা দুঃখ পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমরা নিজেরাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্ণবাদী সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করছি এবং এর দ্বারা প্রভাবিত।

বর্ণবাদের মূলে রয়েছে অপরের প্রতি ঘৃণা ও অবিশ্বাস। এর বাইরেও গোষ্ঠীগত ও সর্বোপরি ব্যক্তির ক্ষমতা তৈরি ও চর্চার জন্যই বর্ণবাদের আদর্শ ধারণ করা হয়। আর এই ক্ষমতা চর্চার প্রত্যেকটি লক্ষণই আমরা আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে দেখতে পাই।

 

বর্ণবাদ কি শুধুই সাদা-কালো? 
রঙ সাদা নাকি কালো- এই বিবেচনা দিয়ে নারীর গুণ নির্ধারণ হয় আমাদের সমাজে। বলা হয়, আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারি। আর সাদাতেই সব দর্শন উপযোগিতা আটকে গেছে। কিন্তু বর্ণবাদ কি শুধুই সাদা-কালো? সমাজ গবেষকরা বলছেন, কেবল রঙ না, এটি প্রবল আর প্রান্তিকতার বিষয়। আধিপত্য আর ক্ষমতার বিষয়। গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন, কীভাবে সব পর্যায়ে বহুজাতিক কোম্পানি নাছরবান্দা। সবাইকে সে সাদা হওয়ার উপায় বাতলে দিয়েছে। কালোকে সে অগৌরবের, অসাফল্যের প্রতীক করে তুলেছে। উপনিবেশিক শক্তি দেশ ছেড়ে গেলেও মন ছেড়ে যাবার উপায় রাখেনি। ফলে সাদা বা কালো রঙ না, রঙের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অর্থ বর্ণবাদ লালন করে। নারী কেবল ফরসা হলেই হবে না, নারীকে ‘নিঁখুত’ও হতে হবে। ইতিহাস আমাদের বলছে, নারীর নিখুঁত হওয়ার মাপকাঠি সব সময়ে একই রকম নয়। এটা নির্ভর করে নির্দিষ্ট অঞ্চল, ট্রেন্ড, শ্রেণি ও সময়ের ওপর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. কাবেরি গায়েন ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের চারটি প্রধান দৈনিকে প্রকাশিত ৪৪৬টি পাত্র চাই, পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, সমাজে কালো মেয়েরা ভয়ানকভাবে অবজ্ঞার শিকার। বিয়ের জন্য ফর্সা মেয়েই পরম কাঙ্ক্ষিত। বিষয়টির আরও গভীরে অনুসন্ধান চালিয়ে এই গবেষক জেনেছেন, ফর্সা না হওয়ায় শহরে-গ্রামে অসংখ্য নারী গঞ্জনা, নির্যাতন সহ্য করে বাঁচে কিংবা আত্মঘাতী হয়। দৈনিক সংবাদপত্রের শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপন নিয়ে গবেষণা কর্ম সম্পাদনের ১৫ বছর পরেও সমাজে খুব উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি বলেই মনে করেন তিনি। কাবেরী গায়েন বলেন, ‘সমাজে কালো মেয়েদের অস্তিত্বেই বিশ্বাস নেই। কালোকে সে অগৌরবের, অসাফল্যের প্রতীক করে তুলেছে। মেধা, বুদ্ধি, সাহস সাফল্য সবকিছুকে নামিয়ে নারীর সাফল্যের সুখের ঠিকানা নির্মাণ করে দিয়েছে ফর্সা রঙে। এ পৃথিবী তাই কালো মেয়ের চাহিদা তো দূরে থাক, মেয়ে মানেই ফর্সা হতে হবে। ইউরোপ কেন্দ্রিক সৌন্দর্যের ধারণায় বাধা পড়েছে মনস্তত্ত্ব। আসলে এটি দাসত্বের হীনমন্যতা বোধ। ব্রিটিশ থেকে শুরু করে যারাই এই দেশ জয় করেছে, তাদের গায়ের রং ফর্সা ছিল। রাজার রঙের প্রতি সমীহ, যাকে শক্তপোক্ত করেছে বিশ্ব পুঁজির সৌন্দর্যবাজার, সেও ইউরোপ কেন্দ্রিক।

পশ্চিমা দেশে গায়ের রঙে বর্ণ চেনা গেলেও, বর্ণবাদ স্রেফ গায়ের রঙ ভিত্তিক না উল্লেখ করে নৃবিজ্ঞানী নাসরিন খন্দকার বলেন, শ্বেতাঙ্গ মানুষের দাস বাণিজ্য আর উপনিবেশিক ইতিহাস থেকে উঠে আসা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের বিপরীতে সব জাতি, সব বর্ণ এবং সব ধর্মের মানুষ বর্ণবাদের স্বীকার। বর্ণবাদ তাই যতটা সাদা-কালো বলে মনে হয়, ততোটা সাদা কালোর বিষয় নয়। এটি প্রবল আর প্রান্তিকতার বিষয়, আধিপত্য আর ক্ষমতার বিষয়। উপনিবেশ শাসক চলে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে তাদের বর্ণবাদ আমাদের মধ্যে, ফর্সা গায়ের রঙয়ের প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্বে। বর্ণবাদের শেকড় থাকে ওপরের প্রতি ঘৃণা আর নিজের অহমে। ক্ষমতার হাত ধরে আজকে আমাদের দেশজ বর্ণবাদের স্বীকার আদিবাসী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু।