কালের দর্পণে মসজিদুল আকসা

:: গোলাম রাজ্জাক কাসেমী ::
প্রকাশ: ১১ মাস আগে
মসজিদুল আকসা। ফাইল ছবি

মসজিদুল আকসা। পবিত্র মক্কা ও মদিনার পর জেরুজালেমে অবস্থিত ঐতিহাসিক এই মসজিদটি ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান। প্রতি বছর ফিলিস্তিনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মুসলিম আসেন এই মসজিদ প্রাঙ্গণে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে (বিশেষ সাওয়াবের উদ্দেশ্যে) সফর করো না। সে তিনটি মসজিদ হলো- মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসা।’ (বুখারি : ১১৮৮)
নানা তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্যের কারণে মসজিদুল আকসার গুরুত্ব মুসলমানদের কাছে অপরিসীম। যেমন এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদ। আবু জর গিফারি (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! সর্বপ্রথম কোন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বললেন, মসজিদুল হারাম। আমি বললাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল আকসা। আমি বললাম, এ দুইয়ের নির্মাণের মাঝে পার্থক্য কত? তিনি বললেন, ৪০ বছর। (বুখারি : ৩৪২৫)
ইসরা ও মিরাজের রাতে আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে মসজিদুল আকসা পরিভ্রমণ করান। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১)
মসজিদুল আকসায় এক ওয়াক্ত নামাজ পড়া অন্যান্য স্থানের তুলনায় এক হাজার গুণ সাওয়াব মিলে। মাইমুনা বিনতে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে আমাকে অবগত করেন। তিনি বলেন, এটা হাশরের মাঠ এবং সকলের একত্র হওয়ার ময়দান। তোমরা তাতে নামাজ আদায় করবে। কেননা সেখানে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়া অন্যান্য স্থানের তুলনায় এক হাজার গুণ উত্তম। আমি বললাম, যদি সেখানে যেতে সক্ষম না হই? তিনি বলেন, তুমি তাতে বাতি জ্বালানোর জন্য জলপাইয়ের তেল হাদিয়া পাঠাও। যে ব্যক্তি তা করল, সে যেন সেখানে উপস্থিত হলো। (ইবনে মাজাহ : ১৪০৭)
এ ছাড়াও আল-আকসা ইসলামী শিক্ষা ও মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির তীর্থভূমি। মুসলিম শাসকদের জনকল্যাণমূলক বহু কাজের স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করে আছে পবিত্র এই ভূমি।

আল-আকসা কমপ্লেক্সের আয়তন :
প্রায় ১৪ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত আল আকসা কমপ্লেক্স একক কোনো স্থাপনা নয়। চার দেয়াল বেষ্টিত এ কমপ্লেক্সে মসজিদ, মিনার মেহরাব ইত্যাদি মিলিয়ে ছোট বড় প্রায় দুইশত ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে।

মসজিদুল আকসা আসলে কোনটি?
আল-আকসা মসজিদ বলতে কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ (কুব্বাতুস সাখরা) ও বুরাক মসজিদ (৩টির) সমন্বয়কে বুঝায়- যা জেরুজালেমের ‘হারাম শরীফ’-এর চার দেয়ালের মধ্যেই অবস্থিত।
তবে মূল আল আকসা বা কিবলি মসজিদ হলো- ধূসর সীসার প্লেট দ্বারা আচ্ছাদিত গম্বুজওয়ালা স্থাপনাটি।
আর আল-আকসা নামে অধিক প্রসিদ্ধ সোনালী গম্বুজ বিশিষ্ট স্থাপনার নাম মসজিদে কুব্বাতুস সাখরা। যা উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান ৭২ হিজরিতে নির্মাণ করেন।
তবে এটিকে আল-আকসা বললেও সমস্যা নেই; কারণ,মসজিদটি ‘হারাম আল শরীফ’-এর চৌহদ্দিতেই অবস্থিত।

আল-আকসার নির্মাতা :
মসজিদুল আকসা সর্বপ্রথম কে নির্মাণ করেন তা নিয়ে মতভিন্নতা আছে।
এর মধ্যে প্রধান মত তিনটি। তা হলো, মানবজাতির পিতা আদম (আ.), নুহ (আ.)-এর ছেলে সাম ও মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)। তবে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ আদম (আ.)-কে মসজিদুল আকসার নির্মাতা হওয়ার মতকে প্রাধান্য দেন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদুল হারাম ও মসজিদুল আকসার নির্মাণকালের পার্থক্য বলেছেন ৪০ বছর। আর নির্ভরযোগ্য তথ্য মতে, আদম (আ.) মসজিদুল হারামের নির্মাতা ছিলেন।

পুনর্র্নিমাণ ও সংস্কার :
মসজিদুল হারামের মতো মসজিদুল আকসাও একাধিকবার পুনর্র্নিমাণ ও সংস্কার করা হয়। আদম (আ.)-এর পর খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে ইবরাহিম (আ.) এর পুনর্র্নিমাণ করেন। তাঁর বংশধরদের ভেতর ইসহাক ও ইয়াকুব (আ.) পবিত্র এই মসজিদের পরিচর্যা করেন। অতঃপর খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছর আগে সুলাইমান (আ.) মসজিদুল আকসা পুনর্র্মিমাণ করেন।
মুসলমানদের হাতে আল-আকসা বিজয় :
১৫ হিজরি মোতাবেক ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী ফিলিস্তিন ভূমি জয় করেন এবং আল-আকসা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। বিজয়ের পর খলিফা ওমর (রা.) ফিলিস্তিন সফর করেন। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবু উবাইদা আমের ইবনুল জাররাহ, সাআদ বিন আবি ওয়াক্কাস, খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আবু জর গিফারি (রা.)-সহ সাহাবিদের একটি দল। ওমর (রা.) একটি সন্ধিচুক্তির অধীনে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে আল আকসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে পবিত্র পাথর ও আল-আকসার আঙিনা পরিষ্কার করেন। তিনি আল আকসা মসজিদের দক্ষিণে ছোট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

কালের পরিক্রমায় আল-আকসা :
খোলাফায়ে রাশেদার পর উমাইয়া শাসনের সূচনা হয়। উমাইয়া শাসকদের রাজধানী ছিল দামেস্ক। দামেস্ক ফিলিস্তিনের নিকটবর্তী হওয়ায় উমাইয়া খলিফারা আল-আকসাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তাঁদের সময়ে আল-আকসার মৌলিক অবকাঠামোগত বহু উন্নয়ন হয়। উমাইয়াদের পর আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনাধীন হয় আল-আকসা। কিন্তু তাঁদের রাজধানী বাগদাদ হওয়ায় মসজিদুল আকসার ব্যাপারে তাদের মনোযোগ অনেকটাই কম ছিল। তবে তারা প্রয়োজনীয় সংস্কার ও স্থানীয় ধর্মীয় কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
৯৭০ খ্রিস্টাব্দে রামাল্লার যুদ্ধে আব্বাসীয় বাহিনী মিসরে ফাতেমি বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এর মাধ্যমেই ফিলিস্তিন ভূমির পতন শুরু হয়। ফাতেমিরা ছিল শিয়া ইসমাইলিয়া মতবাদের অনুসারী। তারা মসজিদুল আকসার ওপর নানা ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করে এবং ফিলিস্তিন ভূমিতে ইসলামী শিক্ষাধারা বন্ধ করে শিয়া মতবাদ প্রচারের সুযোগ করে দেন। ফাতেমীয় শাসক হাকিমের শাসনামলের শেষভাগে ১০২১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আল-কুদস ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চায় তার অতীত ঐতিহ্যের সবটুকু হারিয়ে ফেলে।
১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিন সেলজুকদের শাসনাধীন হয়। তারা ছিল সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী। ফলে আল-আকসা তার হারানো মর্যাদা ফিরে পেতে শুরু করে এবং ফিলিস্তিনে আবারও বিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। ধারণা করা হয়, ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে আল আকসায় ইমাম গাজালি (রহ.)-এর আগমন ঘটে এবং তিনি কয়েক বছর অবস্থান করেন। কিন্তু এই সুদিন দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা আল-আকসা দখল করে। তারা মসজিদুল আকসাসহ ইসলামী ঐতিহ্যগুলো ধ্বংস করতে তৎপর হয়।
১১৮০ খ্রিস্টাব্দে মিসরের শাসক সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) ক্রুসেডারদের হাত থেকে ফিলিস্তিন ভূমি মুক্ত করেন। বিজয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে মসজিদুল আকসা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। পরবর্তী জুমা থেকে সেখানে নামাজ শুরু হয়। তিনি নিজ হাতে গোলাপজল দিয়ে আল-আকসা পরিষ্কার করেন। তিনি বিজয়ের প্রতীক হিসেবে একটি মিম্বার তৈরি করেন। এ ছাড়া আল-আকসা কম্পাউন্ডের ভেতর একাধিক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। সালাহুদ্দিন আইয়ুবি ও তাঁর বংশধররা ক্রুসেডারদের একাধিক আক্রমণ থেকে ফিলিস্তিন ভূমিকে রক্ষা করেছিল। মামলুকরা আইয়ুবীয়দের উত্তরাধিকারী হলে তারা আল-আকসার নিরাপত্তায় আত্মনিয়োগ করে। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিন ভূমি উসমানীয় শাসকদের নিয়ন্ত্রণে আসে, যা ১৯১৭ সাল পর্যন্ত অটুট ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের মাধ্যমে পবিত্র এই ভূমির নিয়ন্ত্রণ চলে ব্রিটেনের হাতে। ফলে ফিলিস্তিনে দীর্ঘকালের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম যেভাবে :
১৯১৭ সালে জেরুজালেম ব্রিটেনের দখলে চলে যাওয়ার সময় এখানে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। তারপর শুরু হয় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদিদের এনে ফিলিস্তিনে অভিবাসনের প্রক্রিয়া। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইহুদিরা ফিলিস্তিনে দখলদার ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদদে জায়গা কিনে বসতি স্থাপন করতে থাকে। এভাবে ১০ শতাংশ জমির মালিক হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। আর ব্রিটেন ব্যাপারটি কৌশলে জাতিসংঘে নিয়ে যায়। জাতিসংঘ সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ১০ শতাংশ জমির মালিকদের জন্য গোটা ফিলিস্তিনের অর্ধেকেরও বেশি ভূমি বরাদ্দ করে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।
জাতিসংঘ ইহুদিদের শুধু ফিলিস্তিনিদের জায়গা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। মুসলিম-বিরোধী ভয়ংকর এক নির্দেশনা দেয়। মুসলমানদের নিরঙ্কুশ মালিকানায় থাকা আল-আকসাসহ জেরুজালেমের অধিকার ফিলিস্তিন-ইসরায়েল কাউকেই না দিয়ে এর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা করে জাতিসংঘ। এতে ইসরায়েল খুবই খুশি হয়। কারণ, তা তো মূলত মুসলমানদের জায়গা। আপাতত আল-আকসা ও জেরুজালেমের প্রকৃত মালিকদের নিরঙ্কুশ মালিকানার বিষয়টি প্রতিহত করা গেল। তবে এ ঘোষণার সময় জাতিসংঘের আইনে আল-আকসা ও জেরুজালেমের মালিকানা এককভাবে ফিলিস্তিনিদের হাতে না থাকলেও তার বাস্তব নিয়ন্ত্রণ এককভাবে মুসলমানদের হাতেই ছিল। আল-আকসায় কোনো ইহুদি প্রবেশ করতে পারত না। তা ছিল কেবলই মুসলমানদের।

মুসলমানরা যেভাবে আল আকসার নিয়ন্ত্রণ হারায় :
১৯৬৭ সালে (৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত) ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ নামে খ্যাতÑ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আল-আকসার নিয়ন্ত্রণ হারায় মুসলমানরা। ওই যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েল মসজিদ প্রঙ্গণটি দখল করে নেয়। সেই সাথে পূর্ব জেরুজালেমের বাকি অংশ এবং পশ্চিম তীরের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এসব এলাকা তখন মিশর ও জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বর্তমানে আকসা কমপ্লেক্স ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আল-আকসা পরিচালিত হয় জর্ডান-ফিলিস্তিনের একটি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে। দুঃখের কথা হলÑ এর প্রবেশপথগুলোতে থাকে দখলদার বাহিনী। এখন আল-আকসায় দুই রাকাত নামাজ পড়তেও প্রয়োজন হয় ইহুদি সেনাদের ছাড়পত্র!

লেখক: গোলাম রাজ্জাক কাসেমী; মুহাদ্দিস ও বিভাগীয় প্রধান (আরবি ভাষা ও সাহিত্য), মদিনাতুল উলুম মাহমুদিয়া মাদরাসা, বন্দর নারায়ণগঞ্জ।