কালান্তরে রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিকতা

::
প্রকাশ: ২ years ago

কলরব ডেস্ক: 
রবীন্দ্রজয়ন্তী বা পঁচিশে বৈশাখ বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উৎসব। বাংলা বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে, প্রতি বছর বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে এই উৎসব পালিত হয়। এ বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হতে যাচ্ছে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্য এবং বাংলাদেশে ও বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বিপুল উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব পালন করা হয়। বহির্বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বসবাসকারী বাঙালিরাও এই উৎসব পালন করেন। পশ্চিমবঙ্গে এই দিনটি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।

রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব উদযাপনের অঙ্গ হল রবীন্দ্রসংগীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, রবীন্দ্রনাট্যাভিনয়, রবীন্দ্ররচনাপাঠ, আলোচনাসভার আয়োজন ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত ভবনগুলিতে এই সময় বিশেষ জনসমাগম দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রধান অনুষ্ঠানগুলি আয়োজিত হয় কলকাতায় অবস্থিত কবির জন্মস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও রবীন্দ্রসদন এবং শান্তিনিকেতনে।

বাংলাদেশে সর্বত্র ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হয়। এছাড়া শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ঘিরেও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করা হতো। ঘটা করে, সাড়ম্বরে এ দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বাঙালির ভাষা ও সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, মন-মানসিকতা বিকাশে রবীন্দ্রনাথের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের প্রতি ঋণ স্বীকার করে। কিন্ত এ রবীন্দ্রজয়ন্তী সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এক সুমহান ইতিহাস। যা আমরা অনেকেই জানি না। জেনে নেয়া যাক, রবীন্দ্রজয়ন্তীর ইতিহাস এবং রবীন্দ্রনাথ তার রবীন্দ্রজয়ন্তীকে কোন দৃষ্টিতে দেখতেন!

১৮৮৬ সালের ২৫শে বৈশাখ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখছেন, “আজ আমার জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখ-পচিঁশ বৎসর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এখন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন। জীবন অতি সুখের।” এইটুকু পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথ নিজের জন্মদিন নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। কিন্তু এই ধারণা ভেঙে যাবে যদুনাথ সরকারকে লেখা অন্য একটি চিঠিতে। কবি লিখেছিলেন,“এই সমস্ত বাহ্য আড়ম্বরের উদ্যোগ আয়োজনে আমি যে কিরূপ সঙ্কোচ অনুভব করিতেছি তাহা অন্তর্যামীই জানেন।”

রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবদ্দশায় নিজের জন্মদিন উদযাপন নিয়ে একেবারেই উৎসাহী ছিলেন না। তাই ২৬ বছর বয়সে তার প্রথম জন্মদিন উদযাপিত হয়। তারপরও কবির জন্মদিন আরও ২২ বছর ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহলের আড়ালে ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কবি তার বিশ্বজোড়া গুণগ্রাহীদের আকুল আবেদন ফেরাতে পারেননি। ভক্তদের কাছে হার মেনেছেন কবি।

কবির জীবদ্দশায় রবীন্দ্রজয়ন্তী প্রথম উদযাপিত হয় ১৮৮৭ সালে, কবির তখন ২৬ বছর বয়স। কবির ভাগনি সরলা দেবীর আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ বইটিতে লিখেছেন, “রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা ও নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৮৯ নং পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে উল্টোডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রিটে নিঃশব্দে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা বাজার থেকে আনানো বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন–পাশেই নতুন মামার ঘর। রবির জন্মদিন বলে সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তার জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হল।” -কিন্তু প্রকৃত অর্থে ও সর্বজনীনভাবে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয় ১৯১০ সালে, শান্তিনিকেতনে। কবি সেবার ঊনপঞ্চাশ থেকে পঞ্চাশে পা দিয়েছেন। বিপুল উৎসাহে আশ্রমিকরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেছিলেন ‘আত্মীয়দের উৎসব’ নামে।

রবীন্দ্রজয়ন্তী সাড়ম্বরে প্রথমবার পালিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। সে বছর ৫০ পূর্ণ করে ৫১ তে পা দিয়েছেন কবি। রবীন্দ্রজয়ন্তীকে সফল করতে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের সঙ্গে প্রশান্ত মহলানবিশের নেতৃত্বে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা থেকে বেশ কিছু গুণীজন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন, সত্যেন দত্ত, সুকুমার রায় ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।

বেদ-উপনিষদ পাঠ করে এবং মালা পরিয়ে কবিকে বরণ করা হয়েছিল। কবির মনের কথা সেদিন অনুচ্চারিত থেকে গেলেও, তা প্রকাশ পেয়েছিল নেপালচন্দ্র রায়ের ভাষণে। নেপালচন্দ্র বলেছিলেন, “তোমরা সকলেই গুরুদেবকে ভক্তি কর, কিন্তু তাকে কখনো যেন ঈশ্বরের স্থানে বসিও না”। সত্যি কবি ঈশ্বর হতে চাননি, তিনি তাই লিখেছিলেন– “যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে
সবার পিছে, সবার নীচে, সব-হারাদের মাঝে।”

তিনি সবহারাদের মাঝেই ঈশ্বরকে খুঁজেছিলেন, থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ তাকে আপন খেয়ালে চলতে দেননি। কারণ তিনি সবার। তিনি যে বিশ্বকবি।

১৯৩১ সাল, মহাসমারোহে উদযাপিত হয়েছিল কবির ৭০তম জন্মজয়ন্তী, যা আজও বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর মুখ্য উদ্যোক্তা ছিলেন অমল হোম। উদযাপন কমিটিতে ছিল চাঁদের হাট। কমিটির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, প্রশান্ত মহলানবিশ, সি.ভি.রমণ, রাজশেখর বসু, নজরুল ইসলাম, ইন্দিরা দেবী, কালিদাস নাগ, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা।

কবির সম্বর্ধনা উপলক্ষে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, বাংলা এবং ইংরেজিতে। ইংরেজি বইটির নামকরণ করেন রঁমা রঁলা। তিনি নাম দেন, ‘Golden Book of Tagore’। বইটিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছিলেন কবির গুণমুগ্ধ আইনস্টাইন, ন্যুট হামসুন, হ্যারল্ড ল্যাসকি’র মত বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিরা।

শুধু বৈশাখে নয়, সে বছর ভরা শীতে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে, ২৫শে ডিসেম্বর থেকে ৩১শে ডিসেম্বর কলকাতায় ‘ঠাকুর সপ্তাহ’ পালিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহে ও টাউনহলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। টাউনহলে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি ও লেখার পাণ্ডুলিপি প্রদর্শিত হয়েছিল। ইডেন গার্ডেন প্রাঙ্গণে যাত্রা, কীর্তন, জারি গান,কথকতা, রায়বেশে, দেশীয় খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছিল।

পঁচিশে বৈশাখ ১৯৪১ (৮ই মে) কবির জীবদ্দশার শেষ রবীন্দ্রজয়ন্তী। অত্যন্ত অনাড়ম্বর ভাবে শান্তিনিকেতনে পালিত হয় বিশ্বকবির জীবনের শেষ শেষ রবীন্দ্রজয়ন্তী। শান্তিনিকেতনের ‘উদয়নে’ বসে জীবনের শেষ জন্মদিন উপলক্ষে কবি লিখেছিলেন কয়েকটি লাইন, যা ছিল দার্শনিক কবির জীবনচর্যার নির্যাস,

“আমার এ জন্মদিন মাঝে আমি হারা
আমি চাহি বন্ধুজন যারা
তাহাদের হাতের পরশে
মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।”

রবীন্দ্রজয়ন্তীর জন্য জীবদ্দশাতেই অপমানিত হয়েছিলেন বিশ্বকবি। ১৯১১ সালে বঙ্গীয় পরিষদ যখন রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন করে, তখন তার বিরুদ্ধে কলকাতার একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তারা রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজনের বিরুদ্ধে লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করেন এবং একটি লিফলেট কবিকেও পাঠিয়ে দেন।

শোকাহত কবি ৪ মে (১৯১১) চিঠি লেখেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে। সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “আজ আমার পঞ্চাশ বৎসর পূর্ণ হইবার মুখে এই আর একটি নিন্দা আমার জন্মদিনের উপহার রূপে লাভ করিলাম এই যে, আমি আত্মসম্মানের জন্য লোলুপ হইয়াছি। এই নিন্দাটিকেও নতশিরে গ্রহণ করিয়া আমার একপঞ্চাশত বৎসরের জীবনকে আরম্ভ করিলাম–আপনারা আশীর্বাদ করিবেন সকল অপমান সার্থক হয় যেন”।

কবি সম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লিখতে খাতা ভরে যাবে, কলমের কালি নিঃশেষ হয়ে যাবে কিন্তু তাকে নিয়ে লেখা শেষ হবে না। জীবনের কত দিকে তাঁর বিস্তার, বাঁক এবং বাঁকান্তর!

যখন থেকে সাহিত্য পড়তে শুরু করেছি, তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমি একাকার হয়ে গেছি। সেসময় থেকেই তিনি আমার চিন্তার একটা অংশ হয়ে গেছেন। এটা যে আমার একার ব্যাপার এমন নয়, যেকোনো বাঙালিরই এটা হবে এবং হতে বাধ্য। আমার তো মনে হয়, বাঙালির উপলব্ধির যেসব ক্ষেত্র রয়েছে, তার একটি বড়ো অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার সাহিত্য ও জীবনাচরণ—দুইয়ের বিবেচনাতেই কথাটি লিখছি। এ জন্য রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বাঙালির অস্তিত্ব কল্পনা কোনভাবেই কল্পনা করা যায় না।

রবীন্দ্রনাথের পরিচয় অনেক- কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, সমাজ–সংস্কারক। কিন্তু তার প্রধান পরিচয় কী? কখনো মনে হয় কবি, কখনো মনে হয় গদ্যকার কিংবা গীতিকার হিসেবেই তার শ্রেষ্ঠত্ব। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ—সবকিছুর মধ্যে গোটা মানবজীবনকে তুলে ধরেছেন তিনি। তাই নির্দিষ্ট কোনো শাখায় তার শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ না করে যদি বলি তাঁর লেখার উপাদানে শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, তবে বোধ হয় বেশি সমীচীন হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের এক মহান প্রাণপুরুষ, যার অস্তিত্ব কখনো মুছে ফেলা যাবে না। যেমনটা যায়নি ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়ারকে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যে নক্ষত্র আলো ছড়াতে থাকবে সমগ্র সৃষ্টিব্যাপী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, আছেন এবং সদা থাকবেন আমাদের হৃদয় গহীনে।