পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক:
চলতি বছরের ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম ছোট দেশগুলোর একটি কাতারে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ক্রীড়া ইভেন্ট উপভোগে সারা বিশ্বের লাখ লাখ ফুটবল ভক্তের উপস্থিতি এখন এই দেশটিতে।
জাঁকজমক ফুটবল আয়োজনে মানুষকে মাতিয়ে রাখার পাশাপাশি ইসলামও প্রচার করছে কাতার। মূলত বিশ্বকাপ আয়োজনের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ইসলাম সম্পর্কে মন পরিবর্তন করতে বা এমনকি ধর্মান্তরিত করার জন্য হাজার হাজার অমুসলিম দর্শনার্থীর কাছে শান্তির এই ধর্ম প্রচার করছে দেশটি।
রোববার (৪ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলাম সম্পর্কে মন পরিবর্তন করতে বা এমনকি ধর্মান্তরিত করার জন্য কয়েক হাজার দর্শনার্থীর কাছে পৌঁছানোর জন্য বিশ্বকাপকে কাজে লাগিয়েছে গর্বিত মুসলিম দেশ কাতার।
মূলত মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় এই দেশটি হলো প্রথম কোনও মুসলিম দেশ যারা ফুটবল বিশ্বকাপের মতো বিশাল ইভেন্ট আয়োজন করেছে। আর এই আয়োজন উপভোগে সারা বিশ্বের লাখ লাখ ফুটবল ভক্ত মধ্যপাচ্যের এই ধনী দেশটিতে পৌঁছেছেন এবং তাদের মধ্যে অমুসলিম দর্শকদের কাছেই ইসলামকে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছে কাতার।
এএফপি বলছে, কানাডিয়ান দম্পতি ডোরিনেল এবং ক্লারা পোপা কাতারের রাজধানী দোহার কাতারা সাংস্কৃতিক জেলায় অবস্থিত অটোমান-শৈলীর একটি মসজিদে নামাজের আযান শোনেন। দেয়ালে নীল ও বেগুনি রঙের টাইলসের চমৎকার মোজাইক থাকার কারণে এই মসজিদটি দোহার ব্লু মসজিদ নামে পরিচিত।
মসজিদের সামনে যাওয়ার পর একজন গাইড কানাডীয় এই দম্পতিকে স্থাপনা ঘুরে দেখাতে ভেতরে নিয়ে যান। ৫৪ বছর বয়সী পেশায় অ্যাকাউনটেন্ট ডোরিনেল পোপা বলছেন, কাতারে এসে তারা প্রথমবার ইসলাম সম্পর্কে জানলেন।
তিনি বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও মানুষ সম্পর্কে আমাদের নানা কুসংস্কার আছে। আর সেগুলো মূলত অন্যদের কাছে (কোনও বিষয়বস্তু সম্পর্কে) প্রকাশের অভাবের কারণেই।’
ডোরিনেল পোপার স্ত্রী ক্লারা পোপা পেশায় একজন চিকিৎসক। ৫২ বছর বয়সী ক্লারা বলছেন, ‘(ইসলাম সম্পর্কে) আমাদের মাথায় কিছু ধারণা ছিল এবং এখন হয়তো সেগুলো পরিবর্তন হবে।’
এএফপি বলছে, দোহার ব্লু মসজিদটি তত্ত্বাবধান করে কাতার গেস্ট সেন্টার। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে সারা বিশ্ব থেকে কয়েক ডজন মুসলিম ধর্ম প্রচারককে কাতারে নিয়ে এসেছে তারা। মসজিদের বাইরে ইসলাম ধর্ম ও মহানবী হযরত মোহাম্মদকে (সা.) নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় ছাপানো বহু পুস্তিকা রয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে অ্যারাবিক কফি ও খেজুর।
সিরিয়ার স্বেচ্ছাসেবক জিয়াদ ফাতেহ বলছেন, বিশ্বকাপ হলো লাখ লাখ মানুষকে ইসলামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার এবং এই ধর্ম সম্পর্কে ভুল ধারণা পাল্টে দেওয়ার একটি সুযোগ। কারণ পশ্চিমাদের অনেকেই এই ধর্মকে ভুল বুঝে থাকেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মানুষকে নৈতিকতা, পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব এবং প্রতিবেশী ও অমুসলিমদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্পর্কে (ইসলামের শিক্ষা) ব্যাখ্যা করি।’
মসজিদের কাছে স্বেচ্ছাসেবকরা একটি টেবিল রেখেছেন। যেখানে লেখা রয়েছে: ‘আমাকে কাতার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন’। সেখানে যেসব দর্শনার্থী থামছেন, তাদের অ্যারাবিক কফিও পরিবেশন করা হচ্ছে।
সোমায়া নামে একজন ফিলিস্তিনি স্বেচ্ছাসেবক বলছেন, অমুসলিম দর্মনার্থীরা সবচেয়ে বেশি যেসব বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন, তা হলো- পর্দা, বহুবিবাহ এবং ইসলামে নারীরা নির্যাতিত কি না।
কাতারের এই মসজিদের কাছাকাছি স্থানে দর্শকরা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পাঁচ মিনিটের ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি ট্যুর উপভোগ করতে পারছেন। এর পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম ও এর সৌন্দর্য সম্পর্কে কাতারজুড়ে নানা প্রচারণাও চালানো হচ্ছে।
কাতারের পার্ল জেলায় ভালো চারিত্রিক ও নৈতিকতার আহ্বান জানিয়ে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নানা হাদিসের ম্যুরাল আঁকা হয়েছে। এছাড়া উচ্চমানের শপিং মলগুলোতে ইসলাম ধর্মের প্রচারণামূলক নানা বিজ্ঞাপনও রয়েছে।
এএফপি বলছে, কাতারের সৌক ওয়াকিফ বাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার ফুটবল ভক্ত জড়ো হয়ে থাকেন। সেখানেই একটি অংশে বিনামূল্যে বহু বই এবং পুস্তিকা রেখে দেওয়া হয়েছে। সেখানে লেখা আছে: ‘যদি আপনি সুখের সন্ধান করেন… তবে আপনি (এটি) ইসলামেই পাবেন’।
সৌকের কাছে অবস্থিত শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে ভ্রমণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীদের ট্যুরের জন্য প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা খোলা থাকে এই ইসলামিক কালচারাল সেন্টারটি।
এছাড়া কাতারের কিছু মুসলিম নেতা অমুসলিম ফুটবল ভক্তদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা চালাতে আহ্বানও জানিয়েছেন।
কাতার ইউনিভার্সিটির শরিয়া আইনের অধ্যাপক সুলতান বিন ইব্রাহিম আল হাশেমি ভয়েস অব ইসলাম নামে একটি রেডিও স্টেশনের প্রধান হিসেবেও দায়িত্বপালন করছেন। তিনি বলছেন, ফুটবল বিশ্বকাপকে নতুন ধর্মান্তরিতদের খুঁজে বের করার পাশাপাশি ইসলামোফোবিয়া মোকাবিলায় ব্যবহার করা উচিত।
অধ্যাপক হাশেমি এএফপিকে বলেছেন, বিদেশি ফুটবল ভক্তদের সাথে দেখা হলে, আমি তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব দেব।
অধ্যাপক সুলতান বিন ইব্রাহিম আল হাশেমির ভাষায়, ‘যদি আমি সুযোগ পাই, আমি তাদের স্বাচ্ছন্দ্য ও অনুগ্রহের সাথে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব দেব এবং যদি আমি সুযোগ না পাই তবে আমি তাদের বলব, আপনি আমাদের অতিথি এবং মানবতার ভাই।’
তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইসলাম জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত হওয়াকে মেনে নেয় না।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া বহু পোস্টে দাবি করা হয়েছে, বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতারে গিয়ে শত শত ফুটবল ভক্ত ধর্মান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু এএফপি-এর ফ্যাক্ট-চেকিং পরিষেবা দেখাচ্ছে- ধর্ম পরিবর্তনের এসব দাবি সঠিক নয়।
কাতারের রিলিজিয়াস এনডোমেন্টস মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এএফপিকে বলেছেন, ‘ইসলামে ধর্মান্তরিতদের সংখ্যা নয়, বরং যারা এই ধর্ম সম্পর্কে যারা নিজেদের মতামত পরিবর্তন করছেন তাদের সংখ্যাই’ কাতারের লক্ষ্য।