পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক:
২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১০৩৪ জন শ্রমিক নিহত এবং ১০৩৭ জন শ্রমিক আহত হন। কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৩৫ জন শ্রমিক নিহত এবং ১৫৫ জন আহত হন। বিভিন্ন সেক্টরে ১৯৬টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ১১৫টি শ্রমিক অসন্তোষ ঘটে তৈরি পোশাক খাতে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ- বিলস্ এর সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের উপর ভিত্তি করে “বাংলাদেশের শ্রম ও কর্মক্ষেত্র পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদপত্র ভিত্তিক বিল্স জরিপ-২০২২” এ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। জরিপে দুর্ঘটনা, নির্যাতন, শ্রম অসন্তোষ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলীর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১০৩৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় (২০২১ এর তুলনায় যা ২% কম), এরমধ্যে ১০২৭ জন (৯৯%) পুরুষ এবং ৭ জন (১%) নারী শ্রমিক। খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ৪৯৯ জন (৪৮%) শ্রমিকের মৃত্যু হয় পরিবহন খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১৮ জন (১১%) শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণ খাতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১২ জন (১১%) শ্রমিকের মৃত্যু হয় কৃষি খাতে।
এছাড়া দিনমজুর ৪৬ জন (৫% এর কম), কনটেইনার ডিপোতে ৪৪, মৎস্য ও মৎস্য শ্রমিক ৪৩ জন, ইলেক্ট্রিক শ্রমিক ২২ জন, নৌ-পরিবহন খাতে ১৫ জন, হোটেল রেস্টুরেন্ট শ্রমিক ১২ জন, ইটভাটা শ্রমিক ১০ জন, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প শ্রমিক ৭ জন, ক্যামিকেল ফ্যাক্টরী শ্রমিক ৬ জন এবং অন্যান্য খাতে ১০০ জন শ্রমিক নিহত হন।
২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১০৩৭ জন শ্রমিক আহত হন, এরমধ্যে ৯৬৪ জন (৯৩%) পুরুষ এবং ৭৩ জন (৭%) নারী শ্রমিক। মৎস্য খাতে সর্বোচ্চ ৫০৩ জন (৪৯%) শ্রমিক আহত হন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কনটেইনার ডিপোতে ১২৫ জন (১২%) আহত হন। তৃতীয় সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক খাতে ৯০ জন (৯%) শ্রমিক আহত হন। এছাড়া পরিবহন খাতে ৮৭ জন (৮%), নির্মাণ খাতে ৮৬ জন (৮%), নৌ পরিবহন খাতে ২৫, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে ২৩ জন, উৎপাদন শিল্পে ১৫ জন, কৃষি শিল্পে ১৫ জন, মেডিসিন ফ্যাক্টরীতে ১২ জন, দিনমজুর ৯জন, স্টিল মিলে ৭ জন এবং অন্যান্য খাতে ৪০ জন শ্রমিক আহত হন।
সড়ক দুর্ঘটনা, বিদ্যুৎষ্পৃষ্ট হওয়া, বজ্রপাত, অগ্নিকান্ড, সমুদ্রে ঘুর্নিঝড়ে ট্রলার ডুবি, পড়ন্ত বস্তুর আঘাত, মাথায় কিছু পড়া, বিষাক্ত গ্যাস, নৌ দুর্ঘটনা, দেয়াল/ছাদ ধ্বসে পড়া, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ইত্যাদি কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার অন্যতম কারন।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১০৫৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় এবং আহত হন ৫৯৪ জন শ্রমিক। নিহতদের মধ্যে ১০০৩ (৯৫%) জন পুরুষ এবং ৫০ (৫%) জন নারী শ্রমিক ছিলেন। এছাড়া ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন খাতে ৭২৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় এবং আহত হন ৪৩৩ জন শ্রমিক ।
জরিপ অনুযায়ী ২০২২ সালে কর্মস্থলে আসা যাওয়ার পথে ৩৬ জন শ্রমিক নিহত এবং ১২২ জন শ্রমিক আহত হন। নিহত শ্রমিকদের মধ্যে ১৩ জন (৩৬%) নারী শ্রমিক এবং আহত শ্রমিকদের মধ্যে ৫৩ জন (৪৩%) নারী শ্রমিক ছিলেন। উল্লেখ্য ২০২১ সালে কর্মস্থলে আসা যাওয়ার পথে ৯১ জন শ্রমিক নিহত এবং ১১৪ জন শ্রমিক আহত হন।
সংবাদপত্র ভিত্তিক জরিপ অনুযায়ী ২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন ৩৩৮ জন শ্রমিক। এরমধ্যে ২৯৪ জন (৮৭%) পুরুষ এবং ৪৪ জন (১৩%) নারী শ্রমিক। ৩৩৮ জনের মধ্যে ১৩৫ জন নিহত, ১৫৫ জন আহত, ৩৪ জন নিখোঁজ, ১ জনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয় এবং অপহৃত ১৩ জনকে পরবর্তীতে উদ্ধার করে পুলিশ। অপহৃতদের মধ্যে ১০জন মৎস্য শ্রমিক এবং তিনজন ইটভাটা শ্রমিক ছিলেন।
সবচেয়ে বেশি ৯০ জন (২৭%) শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন পরিবহন সেক্টরে, যার মধ্যে ৬৪ জন নিহত, ২৬ জন আহত হন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৬ জন (২০%) শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন মৎস্য খাতে, যার মধ্যে ৪ জন নিহত, ২২ জন আহত, ৩০ জন নিখোঁজ এবং ১০ জন শ্রমিককে উদ্ধার করে পুলিশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩৩ জন (১০%) গৃহশ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন, যার মধ্যে ১২ জন নিহত, ২০ জন আহত, ১ জনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ৩৩ জন গণমাধ্যমকর্মী নির্যাতনের শিকার হন, যার মধ্যে ১জন নিহত এবং ৩২জন আহত হন। ২৯জন নিরাপত্তা কর্মী নির্যাতনের শিকার হন, যার মধ্যে ১০ জন নিহত এবং ১৯জন আহত হন। কৃষি খাতে ২৫জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন, যার মধ্যে ১৮জন নিহত, ৬জন আহত এবং ১ জন নিখোঁজ হন।
কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে, শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, ছুরিকাঘাত, খুন, রহস্যজনক মৃত্যু, অপহরণ, মারধর ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন ২৮৬ জন শ্রমিক। এরমধ্যে ২৩২ জন পুরুষ এবং ৫৪ জন নারী শ্রমিক। ২৮৬ জনের মধ্যে ১৪৭ জন নিহত, ১২৫ জন আহত, ৬ জন নিখোঁজ, ২ জনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যা, অপহৃত ৫ জনকে উদ্ধার এবং ১ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া, ২০২০ সালে ২৩২ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন।
জরিপ অনুযায়ী ২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রের বাহিরে নির্যাতনের শিকার হন ৩৩০ জন শ্রমিক। এরমধ্যে ২১৩ জন নিহত, ৭৪ জন আহত, ১ জন নিখোঁজ, ৪২ জনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়। ৩৩০ জনের মধ্যে ২৫২ জন (৭৬%) পুরুষ এবং ৭৮ জন (২৪%) নারী শ্রমিক।
কর্মক্ষেত্রের বাহিরে সবচেয়ে বেশি ৮৫ জন (২৬%) শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন তৈরি পোশাক শিল্প শ্রমিক, যার মধ্যে ৪০ জন নিহত, ৩৪ জন আহত, ১জন নিখোঁজ, ১০ জনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৮ জন (১৮%) শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন কৃষি খাতে, যার মধ্যে ৪৩ জন নিহত, ৮ জন আহত এবং ৭জন আত্মহত্যা করেন। তৃতীয় সবোচ্চ ৪৬ জন (১৪%) শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন পরিবহন সেক্টরে, যারমধ্যে ৩৪ জন নিহত, ৭ জন আহত, ৫ জন আত্মহত্যা করেন। এছাড়া নির্মাণ খাতে ২১ জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন, যার মধ্যে ১৬জন নিহত, ২ জন আহত এবং ৩জন আত্মহত্যা করেন। ১৪ জন দিনমজুর নির্যাতনের শিকার হন, যারমধ্যে ৮জন নিহত, ৩জন আহত এবং ৩ জন আত্মহত্যা করেন।
কর্মক্ষেত্রের বাহিরে নির্যাতনের ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে, শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ছুরিকাঘাত, খুন, রহস্যজনক মৃত্যু, অপহরণ, মারধর ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে ৩০০ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রের বাহিরে নির্যাতনের শিকার হন। এরমধ্যে ১৯১ জন নিহত, ৭০ জন আহত, ৩ জন নিখোঁজ, ২৬ জনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যা, অপহৃত ৮ জনকে উদ্ধার এবং ২ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি। ৩০০ জনের মধ্যে ২১৫ জন পুরুষ এবং ৮৫ জন নারী শ্রমিক ছিলেন। এছাড়া ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রের বাহিরে ৩৬৪ জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন।
২০২২ সালে বিভিন্ন সেক্টরে সবমিলিয়ে ১৯৬টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি ১১৫টি (৭৯%) শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে তৈরি পোশাক খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫টি (৮%) শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে বিড়ি শিল্পে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৪টি (৭%) শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে পাট শিল্পে। এছাড়া পরিবহনে ১১টি, টেক্সটাইল শিল্পে ১০টি, হোটেল রেস্টুরেন্ট খাতে ৫টি, রেলওয়ে’তে ৪টি এবং অন্যান্য খাতে ২২টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে।
জরিপ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৮৯টি (৪৫%) শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে বকেয়া বেতনের দাবিতে। এছাড়া দাবি আদায়ে ৪০টি (২০%), বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে ১৯টি (১০%), বেতন বাড়ানোর দাবিতে ১১টি (৬%), লে-অফের কারণে ৭টি, বোনাসের দাবিতে ৬টি এবং অন্যান্য দাবিতে ২৪টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে।
আন্দোলন করতে গিয়ে এসময় ১০ জন শ্রমিক আহত হন। আহতদের মধ্যে ৭ পুরুষ এবং ৩ জন নারী শ্রমিক ছিলেন। আহতদের মধ্যে সবাই টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক ছিলেন।
শ্রমিক অসন্তোষের ধরণগুলোর মধ্যে রয়েছে, বিক্ষোভ (১০৪টি, ৫৩%), মহাসড়ক অবরোধ (৩৫টি, ১৮%), মানববন্ধন (১২টি, ৬%)), ঘর্মঘট (৯টি, ৫%), কর্মবিরতি (৮টি, ৫%), অনশন (৫টি), স্মারকলিপি প্রদান, র্যালি ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে বিভিন্ন সেক্টরে সবমিলিয়ে ৪৩১টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি ১৭২টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে তৈরি পোশাক খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫০টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে পরিবহন খাতে। এছাড়া ২০২০ সালে বিভিন্ন সেক্টরে সবমিলিয়ে ৫৯৩টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে।