মোহাম্মদ আবু নোমান:
গৌরিসেনের মতো খরচ করা খারাপ কিছু নয়। ‘গৌরি সেন’ ভালো কাজেই খরচ করতেন। দুই বাংলা ভাষার প্রবাদে আছে, ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন’। কথায় আছে, ‘নেশার টাকা ভুতে যোগায়’। সচিবের জন্য ৪৩ কোটি টাকা খরচ করে দুটি বাড়ি করলে অনেক উপকার হবে। এটাও একটা ভালো কাজ। এ কাজে বাঁহাত দেওয়ার কোন দরকার আছে কী? ভাবছেন সামনেই দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সরকার মাত্র দুই সচিবের জন্য বাড়ি নির্মাণে কেন ৪৩ কোটি টাকা খরচ করবে? চিন্তার কিছু নেই, আমজনতা যতই কষ্টে থাকুক, প্রবাদের মতো এরকম বিলাসিতার খরচ জোগান দেবে ‘খাদ্যসংকটে থাকা ৬৮ শতাংশের মানুষ’ নামক গৌরি সেন! অর্থাৎ ১৮ কোটি মানুষের দেশে ১২ কোটি ২৫ লাখ মানুষ খাবার কিনতেই হিমশিম খাচ্ছে!
প্রশ্ন হলো কে এই গৌরী সেন? যে সবাইকে এতো… টাকা দিয়ে বেড়ায়? জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার ব্যালী মোরের বান্ডেল চার্চের নিকটেই ১৫৮০খ্রি. গৌরী সেনের জন্ম আর বেড়ে ওঠা। কারো কারো মতে অবশ্য জায়গাটা হুগলী নয়, মুর্শিদাবাদের বহররমপুর। নন্দরাম সেনের সুযোগ্য পুত্র গৌরী সেন। মূলত ব্যবসায়ের সাথেই জড়িত ছিলেন তার পূর্বপুরুষ। সেই সূত্রেই পারিবারিক আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় তরতর করে উঠে যান সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। অভাব-অনটন বা দেনায় জর্জরিত কেউ, এমন খবর পেলেই তিনি দেদারসে সেই অসহায় ব্যক্তিদের অর্থ দান করতেন। যেমন বিপুল পরিমাণে আয় ছিল তার, ঠিক তেমনি দু’হাত ভরে খরচ করতেও কার্পণ্যবোধ করতেন না গৌরী সেন। তাই তো গোটা বাংলায় এক নামে তিনি মুক্তহস্তে অর্থ দানকারী প্রবাদ পুরুষ বনে যান। সেই আমল থেকেই লোকে বলা শুরু করেছে ‘টাকা লাগে, দেবে গৌরী সেন’, এখনো পর্যন্ত তার চল যায়নি।
কিছুদিন যাবৎ ‘দুর্ভিক্ষ’ শব্দটি বড় বেশি শুনছি, তা-ও আবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। বিদুৎ ব্যবহারের সাথে সব বিষয়ে অপচয় কমানোসহ সঞ্চয়ের অনুরোধ জানিয়ে জনগণকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ-খাদ্যসংকট থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ খাদ্যসংকটের পাশাপাশি দেশ যে অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে, দৈনন্দিন জীবনযাপনে সাধারণ মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর উক্ত বক্তব্যগুলো সেই সংকট ও দুরবস্থার একটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও বটে। মানুষ তিন বেলা খাবার খেতে হিমশিম খাচ্ছে। সাধারণ নাগরিকদের বলা হচ্ছে সঞ্চয় করার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেশের অধিকাংশ মানুষের এই পরামর্শ শোনার মতো অবস্থা নেই। জুলাই মাসের হিসাবে দেখা গেছে, অনেক কষ্টে জমানো টাকা মানুষ ভেঙে খাচ্ছে, কেউ সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন, কেউ সংসার চালাচ্ছেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা শেয়ার লোকসানে বিক্রি করে। প্রতিদিন সরকারকে বলতে হচ্ছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এমন হচ্ছে। সেই দেশে এমন পরিস্থিতিতে কেন ৪৩ কোটি টাকা খরচ করে সচিবদের জন্য বাড়ি করতে হবে এখন?
বর্তমানে বাংলাদেশের এই গৌরী সেন হলো আম পাবলিক। এই গৌরী সেনদের টাকাই ব্যাংক থেকে, শেয়ারমার্কেট থেকে লুট করা হয়েছে। দুর্ভিক্ষ আসবে তো কি হয়েছে? যে শহরে মানুষ বিল পরিশোধ করেও ঠিকমতো ওয়াসার পানি পান না, হাড়ি-পাতিল, কলশি নিয়ে মিছিল করতে হয়। সেই শহরের মাঝখানে গৌরী সেনদের খেদমতে ব্যস্ত আমলাদের তো আর সুইমিংপুল বা জলকেলীবিহীন বাড়িতে রাখা যায়না!
আমাদের আমলারা কতো আরাম-আমোদ হারাম করে ‘বিআরটি’ প্রকল্প করেছিলেন। ২০১২ সালে গৃহীত এ প্রকল্প ২০১৬ সালে চালুর কথা ছিল। যে প্রকল্পের কাজ ৪ বছরে শেষ হওয়ার কথা, সেই প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ না হওয়ায় রাষ্ট্রের অপচয় ও জনগণের ভোগান্তি কত বেশি হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও এ প্রকল্পকে ‘গলার কাঁটা’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু গলার কাঁটা কারা তৈরি করেছেন, হয়তো লজ্জায় সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। প্রকল্পের কাজে নানা অনিয়ম অব্যবস্থা ও আর্থিক অপচয় সত্ত্বেও কারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে নির্মাণকাজ করতে গিয়ে ইতোপূর্বে দুর্ঘটনায় ছয়জনের প্রাণ গেছে। সর্বশেষ বিমানবন্দর সড়কে গত ১৫ আগস্ট গার্ডার চাপায় একই পরিবারের পাঁচজন মারা যান। ২ হাজার ৪০ কোটি টাকার বিআরটি প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে (১০৯ শতাংশ) যখন ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা হয়েছে। সে টাকাও দিয়েছে এই গৌরী সেনেরা।
এছাড়া ২০১৩ সালে চীন থেকে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় করে রেল কর্তৃপক্ষ ২০টি ডেমু (ডিজেল-ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন কেনার প্রকল্প হাতে নেয়। সেগুলো রেললাইনে চালুর মাত্র তিন বছরের মাথায় অকেজো হতে শুরু করে। বর্তমানে সব কটি ডেমু ট্রেনই অচল হয়ে পড়ে আছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সে সময় প্রায় ৪৮ লাখ টাকা খরচ করে ডেমুর কার্যকারিতা ও কারিগরি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে আটজন সরকারি কর্মকর্তাকে স্টাডি ট্যুরে পাঠানো হয়েছিল। সে বিদেশ সফর সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, তবে অর্জিত জ্ঞান আর প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। তার মানে কী দাঁড়াল? প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, সেটি আর গৌরী সেনেদের কোনো উপকারে আসছে না।
অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎশক্তি বৃদ্ধিই এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। যে খাতে মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে সরকারকে। গত ১৫ বছরে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। পুরো অর্থই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গেছে কতিপয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে। গড়ে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে এই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। অভিযোগ আছে, কেউ কেউ পুরোনো ও ভাঙাচোড়া বিদ্যুৎ প্লান্ট বসিয়েও ক্যাপাসিটি চার্জ হাতিয়ে নিয়েছে। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট-ফ্যাক্টর ৮০ শতাংশের ওপরে হলেও অনেক রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বছরে তার সক্ষমতার মাত্র ১২ শতাংশ কোনোটি ১৬ শতাংশ উৎপাদনে ছিল। এভাবে অপরিকল্পিত ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্পের বিষয়ে লিখতে গেলে বড় একটি কিতাব হয়ে যাবে। সরকারি অফিস ও সংস্থার দ্বারা বিভিন্ন সময়ে গৃহীত ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে জনসাধারণের অর্থ অপব্যবহার ও অপচয়ের দুঃখজনক চিত্র নতুন কিছু নয়।
যাই হোক, দেশের রাজনীতিবিদ ও আমলা-কামলা সেবকদের (সবাই নয়) শ্রীলংকার রাজাপক্ষের রাজপরিবারের কথা মনে আছে তো? বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা ১৮ কোটি মানুষকে খুশি রাখার পরিবর্তে রাষ্ট্রের গুটি কয়েক কর্মচারীকে খুশী রাখাকেই সহজ মনে করেন। সাধারণ মানুষদের জীবন অতিষ্ঠ করে এত বিলাসিতা প্রকল্প হাতে নিলে এক সময় ওই সুইমিংপুলেই আপনাদের ডোবাবে। দেশের এই সংকটময় সময়ে এত বিলাসিতা প্রকল্প নেওয়ার দরকার কি? একটি পরিবারে কতজন ‘জলকেলিসক্ষম’ সদস্য থাকলে দুই সেট সুইমিং পুল রাখার কথা, তা অঙ্ক করে বের করার মতো বিষয়।
প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুসারে ভবন দুটি হবে তিনতলা। সাড়ে ১৮ হাজার বর্গফুটের প্রতিটি ভবন নির্মাণে ব্যয় হবে সাড়ে ২১ কোটি টাকা। দুটি ভবনেই অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাতে খরচ হবে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আসবাবের পেছনে খরচ হবে দেড় কোটি টাকা। ২টি ভবনের জন্য ৭টি করে মোট ১৪টি এলইডি টেলিভিশন কেনা হবে। এতে ব্যয় হবে ৯ লাখ টাকা। সিসিটিভি সিস্টেম কেনা হবে ৩২টি। তাতে খরচ হবে ৬০ লাখ টাকা। অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থার জন্য পৌনে ২ কোটি টাকা খরচ হবে। মাত্র ৩ তলার ভবনে উঠতে ১ হাজার কেজি লিফটে (ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড) খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। প্রতিটি বাসভবনে দুই সেট সুইমিংপুল হবে। এতে খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা।
‘ঋণের টাকায় ঘি খাওয়া’ একটি কথা আছে। পি কে হাওলাদার একাই নিয়ে গেছেন সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা গায়েব হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী বলেছিল- ‘ব্যাপার না’। আর এখন দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের দায় (করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেট যুদ্ধ) অমুক তমুকের? তাদের অবস্থাতো গোপাল ভাঁড় কার্টুনের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মত। মন্ত্রীর অকর্মন্যতা আর জালিয়াতি জেনেশুনেও কিছু বলবেন না। কারণ, তাতে তার পরোক্ষ সমর্থন আছে।
লাগামহীন দুর্নীতির কারণে আমাদের উন্নয়ন ব্যয় আশপাশের দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। কর্তৃত্ববাদী শাসনে অতিরিক্ত ব্যয়ে উন্নয়নের নামে নানাভাবে অর্থ ছড়িয়ে সুবিধাবাদী শ্রেণি তৈরি করা হয় শাসনক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। এই উন্নয়ন গুটিকতক মানুষের অর্থ তৈরির প্রক্রিয়া, প্রবঞ্চনার গল্প। মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে মাথাপিছু আয়ের কিসসা শুনিয়ে। যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের হাতেই অর্থ। এটা একটা ভয়ংকর অবস্থা।
করোনার প্রকোপ শেষ হয়েছে প্রায় বছর হতে চলল। কিন্তু মানুষের অবস্থা ভালো হওয়া দূরেই থাকুক, কেবল খাবার জোগাড়ে ঋণ করতে বা সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে মানুষকে। অপ্রয়োজনীয় এসব প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন এবং সেগুলোর সূত্রে যাঁরা লাভবান হচ্ছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই খাদ্যসংকটে পড়া ৬৮ শতাংশের ‘গৌরী সেন’ নন; বরং তারা এই অবস্থার সুবিধাভোগী।