মোহাম্মদ আবু নোমান:
বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ বর্তমানে যে দলই সমাবেশ ডেকে থাকে, তারা শত শত মাইল দুর থেকে গাড়ি ও মানুষ ভাড়া করে নিয়ে আসে। এতে জনদুর্ভোগসহ হাসপাতাল অভিমুখী অসুস্থ ও সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলো যে শহরে জনসভা করছে সে শহরে কি মানুষের অভাব আছে যে, রাস্তায় জনদুর্ভোগ তৈরি করে ভাড়া করে শত শত মাইল দুর থেকে মানুষ নিয়ে আসতে হবে? এখন এটা স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কেউই জনগণের কথা ভেবে রাজনীতি করে না। নিশ্চিত করেই বলা যায়, আমাদের প্রিয় দেশটি কঠিন পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
এমন না যে এ সমাবেশ হলে আজকেই সরকার পতন হবে। সরকার তাহলে সকল জনগণকে বিএনপি মনে করে সবকিছু বন্ধ করছে? বিএনপির সমাবেশের বিপরীতে আওয়ামী লীগ আরো বড় সমাবেশ করে দেখাতে পারে। তা না করে পেশিশক্তি দেখানো হলে, বিএনপিকে ঠেকানোর নামে জনগণকে কষ্ট দিলে বিএনপির সাপোর্টার বাড়বে। মানুষকে অতটা বোকা ভাবা ঠিক নয়। সরকার নিজে যানবাহন বন্ধ না করে, মালিক-শ্রমিকদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যানবাহন বন্ধ রাখছে। অতীতে সব সরকারই এমনটা করেছে। বিএনপির আমলে যতবার সমাবেশ ডাকা হতো, ঢাকার চারপাশে অঘোষিত কারফিউ জারি হয়ে যেত।
পাকিস্তানি শাসকচক্র ভোটের রায় বানচাল করায় পাকিস্তান রাষ্ট্রটাই ভেঙে যায়। বহু ত্যাগ ও প্রাণের বিনিময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ ‘স্বাধীন’ করেছেন। হে প্রধানমন্ত্রী! আপনি বাংলাদেশের মানুষের ‘স্বাধীনতা’ দিয়ে যান। দেশের জন্য যার পুরো পরিবার জীবন দিয়েছে, বিগত দিনে ইতিহাস হয়ে থাকার মতো উন্নয়ন। এতো কিছুর পরও কেন এতো ভয়! কেন একটি ভাল ভোটের আয়োজনে আওয়ামী লীগের সাহসের অভাব? বঙ্গবন্ধু যে দলটি করতেন, সে দলের জনভীতি থাকার কথা নয়। কিন্তু সেটাই লক্ষণীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! ভরসা রাখুন, মানুষের উপর। এই দেশের মানুষ ভুল করে না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে আপনার নামও থাকবে।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও নির্বাচন বিষয়ে পাকিস্তানি ধারণা থেকে উত্তরণের কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, কেউ বিরোধী দলের মতামত নিয়ে দেশের উন্নয়নমূলক কাজ করেনি। ভিন্নমতের প্রতি সাধারণ সহিষ্ণতাটুকু দেখাতে কেউ রাজি হয়নি। এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করেছে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ ও এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ অন্যদের নিয়ে আন্দোলন করেছে। এখন বিএনপি ও অন্যান্য দল একই দাবিতে আন্দোলন করছে।
গণতন্ত্র মানে শুধু ভোটের রাজনীতি বা ভোটের সময় মানুষের দুয়ারে-দুয়ারে ঘোরা, হাত-পা ধরা নয়! গণতন্ত্র হলো, গণমানুষ তথা সাধারণ মানুষের কথা বলা, জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা থাকা। কিন্তু বাংলাদেশে এই জবাবদিহিতা আছে কী? জবাবদিহিতা থাকলে দেশে ঘুষ, দুর্নীতি, চুরিচামারি, লুটপাট চলতে পারবে না। বাংলাদেশ বেশকিছু ক্ষেত্রে সত্যিই অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু দেশটিতে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি। দেশের জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন- এই বিষয়ে ফেয়ার কোনো পদ্ধতি আজও কার্যকর হয়নি। এ দায় কারো একার নয়। এ দায় সমানভাবে বর্তায় জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগের ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি বক্তব্য দিচ্ছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে আগামী নির্বাচন থেকে তারা শুধু দুরেই থাকবে না, ওই নির্বাচন বর্জনও করবে। এ দেশের ইতিহাস হলো, যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে, তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যস্ত থাকে। তবে সবারই লক্ষ্য নির্বাচন। নির্বাচনের বৈতরণী পার হলেই পোয়াবারো। আমাদের দেশের রাজনীতি মূলত দোষারোপের রাজনীতির দুষ্টচক্রের আবর্তে আবর্তিত।
বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আবার যদি নির্বাচন নিয়ে নতুন করে কোনো সংকট তৈরী হয়, তাহলে এই মুহূর্তে সেই ঝামেলা সামাল দেওয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের পরিণতি হবে শ্রীলংকা থেকেও আরো ভয়াবহ। আওয়ামী লীগ যদি একতরফা নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয় এবং বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা তা প্রতিরোধের চেষ্টা করে, কী পরিস্থিতি হবে? কারো হাতে ৫০০ টাকার নোট গুজে দিয়ে, এক বোতল পেট্রোল ধরিয়ে দিয়ে বললেই হয় ‘আগুন দিয়ে ঐ বাসে ছুড়ে আয়’। তাতেই কাজ হয়ে যাবে। শ্রীলংকায় যা হয়েছে তাতে কেউই জয়ী হয়নি। রাষ্ট্র পরাজিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায় আগের অবস্থায় আসতে তাদের অনেক অনেক দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। আজ দেশে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে, ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ নয়, বিদেশ থেকে টাকা পাঠালে ব্যাংক দিতে পারবে না। রেমিট্যান্সে এর প্রভাবও ইতিমধ্যে পড়েছে। আমদানি ও প্রবাসী আয়ে হ্রাসের কারণে সরকার বেকায়দায় আছে। তাই নিজ দেশের ক্ষতি ও ধংস করায় উৎসাহ ও রিউমার না ছড়িয়ে বিরোধীদের মানবিক হতে হবে।
বর্তমানে অসহ্য বাজারদাম, চাল, ডাল, তেলের দামে মধ্য ও নি¤œ মধ্যবিত্তরা দিশেহারা। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। বিদ্যুৎ-সংকট, জ্বালানিসংকট, মূল্যস্ফীতি, ডলারের সংকট, মানুষের মেজাজ ঠিক নেই। বৈষম্য আর দারিদ্র্যও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সংকটে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড নিচে নেমে এসেছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, উচ্চ ঋণ নিয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা না হোক, নির্বাচন নিয়ে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘটলে তা সামাল দেওয়া, সংঘাত সংকটের ভার বহন করা সক্ষমতা আমাদের নেই। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যদিনের খরচের বোঝা মানুষজন আর টানতে পারছে না। এসব কারণে সাধারণের উপস্থিতি বিএনপির মিছিলে বাড়ছে।
এর আগে সিইসি মাঠ ছেড়ে না দিয়ে তলোয়ারের বিরুদ্ধে তলোয়ার বা রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। পরে যদিও সিইসি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিনি তলোয়ার ও রাইফেলের প্রসঙ্গটি বলেছেন কৌতুক করে। সিইসির এই বক্তব্যে যে নির্মম সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো, নির্বাচনের নামে দেশে শক্তি পরীক্ষার মহড়া। নির্বাচন কমিশন কৌতুক করে বললেও মাঠে কিন্তু ঢাল-তলোয়ারের খেলা শুরু হয়েছে। সিইসি যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চায়, প্রথমে তাদের কর্তব্য হবে নির্বাচনী মাঠকে তলোয়ারমুক্ত করা। ইতিপূর্বে বিএনপিকে ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক সন্ত্রাস ও হানাহানি ঘটেছে।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তার পক্ষপাতমূলক ভূমিকার কারণে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই এক/এগারোর পটপরিবর্তন ঘটে। বিরোধী দলের আন্দোলন, কূটনীতিকদের সুপরামর্শ উপেক্ষা করে বিএনপি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে দিয়ে একটি জবরদস্তির নির্বাচন করতে গিয়ে যে ভুল করেছিল, নেতারা এখন তা স্বীকার করেন। আওয়ামী লীগও যদি আবারও দেশবাসীর ওপর জবরদস্তির নির্বাচন চাপিয়ে দিতে চায়, তার পরিণতি কী হবে সৃষ্টিকর্তাই জানেন। ক্ষমতা ছাড়লেই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় আটক হবেন ক্ষমতাসীনরা। তাই আমৃত্যু ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা জারি রাখবেন। বিএনপিও ঠিক একই কারণে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করার চেষ্টা করেছিলো অতীতে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগও একই কথা বলত। সে সময়ে আওয়ামী লীগের দাবি যদি যৌক্তিক হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগও এখন সেই দাবিকে অযৌক্তিক ও অসাড় প্রমাণ করবে কীভাবে?
এরশাদ সরকারের পতনের পর তথা ১৯৯০ সালের পর থেকে যত সরকারই এসেছে, যে দৃশ্য বারবার দেখা গেছে তা হলো, বিদেশিদের কাছে ধর্না দেওয়া। অতীতে দেখা গেছে, যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা বিরোধী দলের ন্যায্য দাবিও আমলে নেন না। ফলে বিরোধী দল হরতার, আন্দোলনের নামে জান-মালের হানি, গণমাধ্যমে দেশবাসীকে তাদের দাবিদাওয়ার কথা জানানো, সর্বশেষ বিদেশিদের কাছে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে দাবি মানতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। আমরা বলতে চাই, কেন বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান সে বিষয়টিও ভাবা দরকার। আওয়ামীগের ভুলে যাবার কথা নয়, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ তখনকার দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে কতবার বৈঠক করেছেন বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে। সে সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, কানাডার হাইকমিশনার বারবারা রিচার্ডসন, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার ডগলাস ফসকেট, এমনকি তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরান, মিসর, ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন।
সরকারের আচরণ এমন হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয় যাতে বিরোধীরা অসহায় হয়ে ভিনদেশিদের কাছে সাহায্য চাইতে হয়। এটা কেবল সরকারের জন্য লজ্জার নয়, সরকারের ব্যর্থতাকেও স্পষ্ট করে। এটা ঠিক যে, দেশের নির্বাচন বা গণতন্ত্র নিয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া যতটা অমর্যাদার, তার চেয়ে বেশি লজ্জার সুষ্ঠু নির্বাচন না করার ক্ষেত্র তৈরি করা।
দল-মত নির্বিশেষে অতীতের সকল অজ্ঞতা ও দুর্বলতা এবং ভুলগুলো ভুলে গিয়ে আমাদের দেশ গঠনে অত্যান্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীটাই একটা বিপদের সম্মুখীন। আমরা নিজেরা যদি দলাদলি করতে থাকি, হিংসার আগুনে জ্বলতে এবং জ্বালাতে থাকি তাহলে দিনশেষে ক্ষতিটা আমাদেরই হবে।