ঐতিহাসিক ছয় দফা যেদিন শহীদের রক্তে ভিজেছিল

:: তোফায়েল আহমেদ ::
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ছয় দফা ও ৭ জুন অঙ্গাঙ্গী জড়িত। বাংলার মানুষ ১৯৬৬ সালের এই দিনে স্বাধিকার অর্জন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হরতাল পালন করেছিল। এই দিনে মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ অনেক শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় ঐতিহাসিক ছয় দফা। পরবর্তী সময়ে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সূচনালগ্নে ছয় দফা দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন সমেত ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত হয়। সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা এক দফা তথা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা ছিলেন। জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের অভিপ্রায় থেকেই তিনি জাতির উদ্দেশে ছয় দফা কর্মসূচি প্রদান করেছিলেন। তাঁর হৃদয়ের গভীরে সততই প্রবহমান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যে জন্য ছয় দফাকে বলা হয় বাঙালির মুক্তিসনদ।

বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর কনভেনশনে ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা দাবি’ উত্থাপন ও বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফার বিস্তারিত তুলে ধরেন। ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘ছয় দফা’ দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হয়। এ ব্যাপারে জনমত সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী একের পর এক জনসভা করতে থাকেন; ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে, ২৭ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর মাইজদী, ওই দিনই বেগমগঞ্জ, ১০ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ১১ মার্চ ময়মনসিংহ সদর, ১৪ মার্চ সিলেটে।

ছয় দফার প্রচার ও প্রকাশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের ‘উপকমিটি’ গঠন এবং তাঁরই নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচী’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ ছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। সেখানে পুস্তিকাটি বিলি করা হয়।

কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ কারণে সেখানেই আসা ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে। ছয় দফার ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের খসড়াও অনুমোদন করা হয়। বস্তুত দলীয় গঠনতন্ত্র পরিবর্তন ও নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ছয় দফার চূড়ান্ত পরিণতি এক দফা তথা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ইঙ্গিতবাহী ছিল।

কাউন্সিল অধিবেশনের শেষ দিন চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় দলীয় নেতাকর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকারের এই বাণী লয়ে আপনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশের প্রতিটি মানুষকে জানিয়ে দিন, দেশের জন্য, দশের জন্য, অনাগতকালের ভাবী বংশধরদের জন্য সবকিছু জেনে-শুনেই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা এবার সর্বস্ব পণ করে নিয়মতান্ত্রিক পথে ছয় দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য এগিয়ে আসছে।’

সফলভাবে সমাপ্ত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পর বঙ্গবন্ধু সারাদেশ চষে বেড়ান। ২৬ মার্চ থেকে পরবর্তী ৩৫ দিনে সারাদেশে মোট ৩২টি জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচী’ পুস্তিকাটি এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; বাংলার ঘরে ঘরে তা সযত্নে রক্ষিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ওপর নেমে আসে স্বৈরশাসক আইয়ুবের নির্মম গ্রেপ্তার-নির্যাতন। প্রতিটি সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিটি জেলা থেকে ওয়ারেন্ট জারি হয়। ছয় দফা প্রচারকালে তিন মাসে বঙ্গবন্ধুকে মোট আটবার গ্রেপ্তার করা হয়। সর্বশেষ ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ স্মরণে শ্রমিক-জনতার এক বিরাট সমাবেশে ভাষণদান শেষে রাত ১টায় পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ‘ক’ ধারাবলে তাঁকেসহ ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়।

সামরিক সরকারের এমন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৭ জুন সর্বব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়।

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ অনেকে সেদিন হরতাল কর্মসূচি পালনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটি ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে তেজগাঁয় শ্রমিক মনু মিয়া, আদমজীতে মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন এবং প্রায় আটশ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়।

আজ ৭ জুন, অনেক স্মৃতি মানসপটে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে যাঁর স্নেহে আমার জীবন ধন্য, সেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন যেসব শহীদ ভাই বুকের তাজা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, বাংলার মানুষের মুক্তির পথ প্রশস্ত করে গিয়েছেন, তাদেরকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। প্রকৃতপক্ষে দিনটি ছিল আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার চেতনার প্রারম্ভ বিন্দু। ৭ জুনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন সবার কর্তব্য বলে মনে করি।

লেখক: তোফায়েল আহমেদ, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।