এসএসসিতে ফেল করেও কলেজে ভর্তি এবং আমাদের হইচই

:: মো. নবী আলম ::
প্রকাশ: ৪ মাস আগে

দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানলাম, “এসএসসিতে এক বা দুই বিষয়ে ফেল করলেও কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে ছাত্রছাত্রীরা। তবে পরের দুই বছরের মধ্যে তাকে পাবলিক মূল্যায়নে অংশ নিয়ে বিষয়গুলোতে উত্তীর্ণ হতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে ২০২৬ সালে হবে এসএসসি পরীক্ষা। এরপর ছাত্রছাত্রীরা একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে।”

প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় রীতিমতো হইচই শুরু করেছেন। বিভিন্ন মিডিয়ার ডিজিটাল ভার্সনে এ নিয়ে অনেকের মন্তব্য শুনলাম। মন্তব্যগুলো এমন-‘‘এসএসসিতে ফেল করে সহজে কলেজে চান্স পায় তাহলে তো ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ থাকবে না। এমনিতেই অনেক ছাত্রছাত্রী মোবাইল ও কম্পিউটারে গেম, ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদিতে আসক্ত, সেখানে ফেল করে সহজেই কলেজে ভর্তির সুযোগে তাদের পড়ালেখার প্রতি অনিহা আরও বেড়ে যাবে। ফেল করেও কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের এমন সুযোগে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের মনে প্রভাব পড়বে। ফেল করা ছাত্রছাত্রীর সার্টিফিকেটের মান কোন স্ট্যান্ডার্ডে হবে- দেশের বাইরে আদৌ কি তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে? এমনিতেই এখন পড়ালেখার যে অবস্থা নতুন কারিকুলামে খুব ফান, খুব চিল। পাস করাদের সাথে এটা এক ধরণের বৈষম্য তৈরি করবে। চাকরির ক্ষেত্রে গেলে ফেল করাটা আগে চাকরি পেয়ে যেতে পারে, সে প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কি করবে, প্রতিষ্ঠানকেও ফেল মারবে। ভবিষ্যতে পড়ালেখার মান আরও নিম্নপর্যায়ে চলে যাবে। কলেজে পর্যাপ্ত আসন না থাকায় আসন সঙ্কট দেখা দিবে। ফেল করা ছাত্রছাত্রী কলেজে ভর্তি হতে পারবে এটা তো যুক্তিসঙ্গত নয়।”

এসএসসিতে ফেল করেও কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগের পক্ষে নয় এমন মন্তব্যকারীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের অধিকারও আছে। আশা করি, নীর্তিনির্ধারকগণ তাদের মন্তব্যেগুলো গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়ে ভেবে দেখবেন। আমি সাধারণ মানুষ এবং দেশের একজন নাগরিক। শিক্ষা বিষয়ে আমার কোনো গবেষণা নেই, এমনকি আমি কোনো বিশেষজ্ঞও নই। মন্তব্যকারীদের মন্তব্য সঠিক নয়- তা বলার কোনো অধিকারও আমার নেই। তবে তাদের মন্তব্যের সাথে আমার কিছু দ্বিমত রয়েছে।

বর্তমান একজন ছাত্রছাত্রী এসএসসিতে এক বা দুই বিষয়ে ফেল করে তার শুধু ওই বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় এক বা দুই বিষয়ে ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের কলেজে ভর্তির সুযোগ থাকবে। কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিভিশন কোর কমিটিতে এই প্রতিবেদনটি পাস হয়েছে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে, জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির সভায় এটি চূড়ান্ত হবে।

সরকারের এই সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত হলে আমি সাধুবাদ জানাবো। আমার জানামতে, পাকিস্তান আমলেও এই পদ্ধতি ছিল। এছাড়া, আমার সময় এসএসসিতে যারা এক বিষয়ে ফেল করেছিল তাদের ফলাফল ছিল রেফার্ড। এই রেফার্ড পাওয়া ছাত্রছাত্রী কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। সে চাইলে পরের বছর মানোন্নয়নে পরীক্ষা দিতে পারতো। যা বাধ্যতামূলক ছিল না। আমার দেখা এমন কয়েকজন পরবর্তিতে প্রতিটি উচ্চ স্তরের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে। তারা যদি এই সুযোগ না পেতো হয়তো কেউ কেউ শিক্ষা থেকে ঝরে পড়তো বা কেউ এক বছর পিছিয়ে যেত।

আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই পদ্ধতি তো নতুন নয়। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব নিয়মে তা বাস্তবায়ন করে থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে বা যে কোনো বর্ষে এক বা দুই বিষয়ে ফেল করা কোনো ছাত্রছাত্রী ইয়ার লস না করে সুবিধামতো সময়ে ওই বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে নিয়মিত সেসনে পাস করে তারা কি মেধার সাক্ষর রাখছেন না?

ফেল করেও কলেজে ভর্তির সুযোগে একমত নন এমন মন্তব্যে আমার কিছুটা দ্বিমতের কারণ ব্যাখ্যা করছি। যেহেতু দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যবস্থা চলমান রয়েছে, এসএসসিতে চালু করলে শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরণের কোনো সমস্যা হবে বলে আমার মনে হয় না। যারা বলছেন, ফেল করা ছাত্রছাত্রীরা কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। মোটেও পড়বে বলে মনে হয় না। যদি পড়তো তাহলে তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একই সেসনের কোনো বিষয়ে ফেল করা ছাত্রছাত্রীকে পাস করাদের সাথে পড়ার সুযোগ কর্তৃপক্ষ দিতেন না। বরং ওই ছাত্রছাত্রী ইয়ার লস না করে ফেল করা বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে একই সেসনের ছাত্রছাত্রীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারেন এমন ব্যবস্থা চালু রেখেছেন। তদ্রুপ, এসএসসিতে এক বা দুই বিষয়ে ফেল করা ছাত্রছাত্রীর কলেজে ভর্তির সুযোগে ইয়ার লস হবে না। ফেল করা ছাত্রছাত্রী কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া মানে তো এটা নয়, ওই ছাত্রছাত্রী এসএসসি পাসের সার্টিফিকেট পেয়ে গেছে। সার্টিফিকেট পেতে হলে পরের দুই বছরের মধ্যে তাকে পাবলিক মূল্যায়নে অংশ নিয়ে বিষয়গুলোতে উত্তীর্ণ হতে হবে। কোনো একজন সব বিষয়ে ভালো নম্বর পেয়ে দুর্ঘটনাবশত একটি বিষয়ে ফেল করতেই পারে। তার মানে তো এটা নয় ওই ফেল করা ছাত্রছাত্রী মেধাবী নয়। কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলে ওই ছাত্রছাত্রী পরের দুই বছরের মধ্যে ফেল করা বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়ে হয়তো মেধার সাক্ষর রাখতে পারবে। ভর্তির সুযোগ না পেলে কেউ কেউ বিষন্নতায় ভুগে পড়ালেখা করা বাদ-ই দিয়ে দিবে।

প্রতিবছর শুধু ফেল করার কারণে অনেক ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করে। ভর্তির সুযোগ পেলে হয়তো এই মানসিকতার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে যাবে। অনেক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে এসএসসিতে ফেলের কারণে অঙ্করেই তার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। বাবা-মা মেয়েকে পড়ালেখা না করিয়ে অল্প বয়সে জোর করে বাল্যবিয়ে দিয়ে দেন। কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলে দরিদ্র ঘরের ওই মেয়েটি তার স্বপ্নপূরণে এক ধাপ এগিয়ে যাবে এবং বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পাবে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তির সুযোগে নতুন পরিবেশের সাথে পরিচিত হবে এবং নতুন সহপাঠীদের সাথে বন্ধুত্ব হবে। ফলে অনেক নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে সার্টিফিকেট অর্জন মানে এই নয় তাকে চাকরিই করতে হবে। তিনি তো ভালো উদ্যোক্তা, ভালো লেখক, ভালো শিল্পী, ভালো খেলোয়ার, ভালো সমাজসেবক ইত্যাদি প্রতিভার সাক্ষর রাখতে পারেন। পড়ালেখা মানে শুধুই চাকরি এই ধ্যান-ধারণা থেকে আমাদের বের হতে হবে।

আমার বিশ্বাস, নতুন কারিকুলামের এই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হলে ছাত্রছাত্রীর ইয়ার লস বা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া, ফেলের কারণে না থেমে উচ্চ ক্লাসের নতুন নতুন বই পড়ে ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে পারবে। প্রতিটি ব্যবস্থাপনায় সবল ও দুর্বল দিক আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। দুর্বল দিকগুলো সহজেই কাটিয়ে উঠে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক: মো. নবী আলম, লেখক ও সাংবাদিক।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]