প্রায় ৩২ বছরের সাজা খেটে অবশেষে মুক্তি পেলেন আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান। তবে মুক্তি পেয়েও আনন্দ ছুঁতে পারেনি শাহজাহানের হৃদয়। কারণ আত্মীয় স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই তার। বন্দি দশার এক বন্ধুর বাসা হচ্ছে শাহজাহানের আশ্রয়।
রোববার (১৮ জুন) বেলা পৌনে বারোটায় কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। বের হওয়ার আগে জল্লাদ হিসেবে অনেককে ফাঁসি কার্যকরের ট্রেনিং দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
২৬ জনের ফাঁসির দড়ি টানা সেই জল্লাদ শাহজাহানের বয়স এখন ৭৩ বছর। তার আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউ নেইভ ব্যক্তিগত জীবনেও অবিবাহিত তিনি। শোনা যাচ্ছে, তার এক বোন ঢাকায় থাকেন। তার সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। তাহলে এই বৃদ্ধ বয়সে কীভাবে চলবেন তিনি? কার আশ্রয়ে থাকবেন তিনি?
কারা সূত্রে জানা গেছে, সাজার মেয়াদ কমানোর বাসনায় কয়েদি থেকে জল্লাদ বনেছিলেন শাহজাহান। একের পর এক অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন চার দেয়ালের বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেতে। অবশেষে সেই বাসনা সত্যি হচ্ছে।
১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার জন্মস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে। তিন বোন এক ভাই। বাবার নাম হাসান আলী ভূঁইয়া। মাতা সব মেহের। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত। ১৯৭৪ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন।
তিনি নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
জানা গেছে, একবার তার গ্রামে নারী ঘটিত একটি ঘটনা ঘটে। শাহজাহানের দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে। গ্রামে তাকে নিয়ে বিচারে বসা হয়। সেই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণিত করে তাকে সাজা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই তার ক্ষিপ্ততা শুরু। তিনি অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ করে এই অপমানের চরম প্রতিশোধ নেবেন।
ওই ঘটনার পরে তিনি বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। তার উল্লেখযোগ্য একটি অপারেশন ছিল ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায়। এটাই ছিল তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন। সেখানে অপারেশন শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে।
মানিকগঞ্জে পুলিশ চেক পোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে জান। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মানিকগঞ্জে পুলিশের সাথে গোলাগুলিও হয় কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন পথিমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে ফেলে। তার গতিময় জীবনের এখানেই সমাপ্তি এবং এরপর থেকে তার বন্দী জীবন শুরু।
১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে তার নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতি মামলা এবং অবশিষ্ট ৩৪টি হত্যা মামলা।
কারা সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ ঘাতক, ৬ জন যুদ্ধাপরাধী, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা হত্যার আসামি খুকু মনির, ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানসহ বাংলাদেশের আলোচিত ২৬ জনকে জনের ফাঁসি দিয়েছেন শাহজাহান।
কারাগার থেকে একটি সূত্র জানায়, ২৬ জনের ফাঁসির দড়ি টানার পাশাপাশি (লিভার টানা) যেহেতু জল্লাদ শাজাহান সুশৃংখলভাবে কারাগারে অনেক কাজ করেছেন। তাই কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে, তাহলে কারাগারের ভেতরেই তাকে বাগানে অথবা অন্য কোনো কাজ দেওয়া যেতে পারে।
রোববার (১৮ জুন) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ) থেকে সূত্র এইসব তথ্য জানান।
কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, কারাগারে থাকা অবস্থায় জল্লাদ শাহজাহানের সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছে কিনা এই পর্যন্ত আমাদের নজরে পড়েনি। প্রথম দিকে হয়তো বা এসেছিল। জল্লাদ শাজাহান যদি চায় আর কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে তাকে কারাগারের বাগানসহ কিছু জায়গা আছে কাজে লাগানো যায়। তাহলে তারা তাকে সেই কাজ দিতে পারে। কারণ তিনি কারাগারে ভেতরে অনেক কাজ করেছেন। এসব কারণে কর্তৃপক্ষের কাছে তার কাজ চাওয়ার একটা অধিকারও সৃষ্টি হয়েছে।
কারাগারের তথ্যানুযায়ী, জল্লাদ শাজাহান ২০০১ সাল হতে এ পর্যন্ত তিনি ২৬ জনের ফাঁসি দিয়েছেন। যার মধ্যে ৬ জন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, ৪ জন যুদ্ধাপরাধী, ২ জন জেএমবি ও ১৪ জন অন্যান্য আলোচিত মামলার আসামি।
‘জল্লাদ’ শাহজাহানের পুরো নাম শাহজাহান ভূঁইয়া। তিনি নরসিংদী জেলার পলাশ থানার ইছাখালী গ্রামের মৃত হাছেন আলীর ছেলে।
কারাগারে শাহজাহানের কয়েদি নম্বর ছিল ২৫৮৯/এ। মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান জল্লাদ ছিলেন।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, শাহজাহান ১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম গ্রেপ্তার হয়ে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে আসেন। দুটি মামলায় তার ৪২ বছরের সাজা হয়েছিল। পাশাপাশি সেসব মামলায় জরিমানা হয়েছিল পাঁচ হাজার করে ১০ হাজার টাকা।
কিন্তু কারাগারের মধ্যে ভালো কাজ এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে জল্লাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তার সাজার মেয়াদ ১০ বছর মওকুফ (রেয়াত) করা হয়। পাশাপাশি শাহজাহানের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ তার জরিমানার ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করে দেয়।
ফলে দীর্ঘ ৩১ বছর ছয় মাস দুই দিন কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি জীবন কাটানোর পর আজ তিনি মুক্ত হলেন।