এমন জয় কতটা গৌরবের!| মোহাম্মদ আবু নোমান

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ১০ মাস আগে

একটি দেশের রাজনীতি যখন ঠিক পথে থাকে না, তখন সে দেশের অর্থনীতিও ঠিক পথে থাকে না, থাকতে পারে না। বহুদিনের গর্জন ও হুঙ্কারের পর ৭ জানুয়ারি ফাইনাল খেলা (ভোট) শেষ হলো। রাজনীতি কোনো যেনতেন খেলা নয়। দূরদর্শী কৌশল, অর্থ আর পেশিশক্তির খেলা। রাজনৈতিক চালে জটিল আর কুটিলতা থাকলেও বাহিরে থাকতে হয় নিখুঁত পরিকল্পনা, পরিপক্ব প্রদর্শন, থাকবে সুনিপুন আয়োজন। কিছুদিন ভিডিও বার্তা দেয়া ও ঘরের মধ্যে বসে লিখিত ভাষণ দিয়ে রাজনীতি চলে না। রাজনৈতিক চালে এক্ষেত্রে বিএনপি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে কর্মের দোষে… গ্যারাকলে আজ। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উদ্দেশ্য করে মোহন লালের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘রাজাকে রাজনীতি জানতে হয়’।

বিএনপিকে বুঝতে হবে- রাজনীতিতে চাল দিতে না জানলে রাজনীতি করা যায় না। বিএনপি ইতোপূর্বে দেশ শাসনে এমন কিছু করেনি যে, জনগণ তাদের ধরে নিয়ে চেয়ারে বসায়ে দেবে। তাদের জনপ্রিয়তা যতটুকু লক্ষণীয় তা আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণ। রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক লড়াকু সৈনিক দরকার। সুবিধাবাদী কিছু লোকজন নিয়ে রাজনীতি চলে না।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের আচার-আচরণ দেখে মনে হচ্ছে- আওয়ামী লীগের অনুগত সুবোধ বালক ওরা! কেউ বিএনপিকে কোলে বসিয়ে ভোট তাদের মুখে মুখে তুলে দিবে না। পৃথীবির সব ভাষাতেই যে প্রবাদটি রয়েছে, ‘রোম যখন পুড়ছিলো, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলো’। তেমনিভাবে সম্রাট নিরোর মতো বাংলাদেশের মানুষ যখন নিজেদের ভোট দেয়ার স্বাধীনতা হারায় বিএনপি তখনও নিষ্ক্রিয়!

৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র বা ডামি, ১৪ দলের শরিক, মহাজোটের শরিক জাপা এবং হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিংস পার্টি। অভিনন্দন স্বতন্ত্র, ডামি, শরিক, মহাজোট, কিংস পার্টির বিজয়ী প্রার্থীদের। গণতন্ত্র হলো একসঙ্গে চলা, একসঙ্গে কাজ করা। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একসঙ্গে চলা বা কাজ করাতো দুরের কথা, কেউ কারো ছায়াও দেখতে চায় না। সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্রে এক দলীয় বা ‘আমি+ডামি’ প্রতিদ্বন্দ্বিতাই শেষ কথা নয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে হয় দলের সঙ্গে দলের, ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, অনেকের মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করার সুযোগ। যা গত নির্বাচনে ছিল না।

৭ জানুয়ারির ভোটে আওয়ামী লীগের যতটুকু না বিজয় হয়েছে, তার চেয়ে বড় পরাজয় হয়েছে নৈতিকতার। সেই নৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ অদুর ভবিষ্যতে আর ফিরে পাবে কী? নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে, জনগণ হরতাল আহ্বানকারীদের প্রত্যাখ্যান করেছে, উন্নয়নের পক্ষে জনগণের রায় হয়েছে! এ আওয়াজ সর্বত্র। এটা অনস্বীকার্য, উন্নয়ন অবশ্যই লাগবে। কিন্তু গণতন্ত্রের ঘাটতি বাড়িয়ে উন্নয়নকে টেকসই করা কী সম্ভব? গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সকল দল ও মতকে আস্থায় নেয়াটাই আসল। সব দিক মিলিয়ে এবার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার একটা নির্বাচন হলো। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আরেকবার আইনগতভাবে ক্ষমতায় থাকার বৈধতা পেতে যাচ্ছে। কিন্তু তারা নৈতিক বৈধতার সংকটে পড়ল।

জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে যে কোনো দেশ নানামুখী সঙ্কটে থাকে। নির্বাচনের পর সেসব সঙ্কট কেটে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক ও অস্থিরতা দূর হলো না। বরং তা বেড়ে যেতে পারে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। দেশ অর্থনৈতিক সংকটে আছে, এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট যুক্ত হলে তা হবে ভয়াবহ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের অর্জন কিছুই হলো না। রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার খুব একটা আশা দেখা যায় না। নতুন বছর নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসার কথা। কিন্তু ২০২৪ সাল দেশের মধ্যবিত্ত বা নিুবিত্তদের জন্য সম্ভাবনা নিয়ে আসবে নাকি আরও দুর্ভাবনার মধ্যে নিয়ে যাবে, তা আসলে সময়েই বলে দেবে।

সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। দেশের ৭০ ভাগ মানুষেরই ‘নুন আনতে পানতা ফুরানো’র দশা। মুদ্রাস্ফীতি সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। জিনিসপত্রের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিুগামী। রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমন ঘটেছে। অনিয়ম, সি-িকেট কারবারি, সীমাহীন ঘুষ-দুর্নীতি, ব্যাংক লোপাট, টাকা পাচার ইত্যাদি এখন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির গলা চেপে ধরেছে। সাধারণ কর্মজীবী সবার মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছে।

গণতন্ত্রের মানেই হলো অর্থপূর্ণ নির্বাচন। একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে গেলে সব দলকে নির্বাচনে আসতে হবে এবং ভোটারের উপস্থিতি বেশি থাকতে হবে। এ দুটোর কোনোটাই এবারের নির্বাচনে দেখা গেল না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর এবারের নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক হলো না। দেশ কার্যত দীর্ঘস্থায়ী একটা একদলীয় সরকারব্যবস্থার মধ্যে পড়ে গেল। বাংলাদেশের রাজনীতি কখনোই লেখা, আন্দাজ ও অনুমানের পথে চলে না। সেই ধারনা থেকেই বলা যায়- আগামীতেও চলার সম্ভাবনা কম! তার অর্থ আরো রক্তারক্তি, আরো জ্বালাও, পোড়াও, সহিংসতা ও জনজীবনকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাস বারবার এই সত্যটাই প্রমাণ করেছে। বৃটিশ, পাকিস্তান, মুশতাক, মুজিব, জিয়া, এরশাদ, বিএনপি, আওয়ামী লীগ ইতিপূর্বে সকলেই বলপ্রয়োগের পর তারা হেরেছে। দেশের মানুষ তাদের দ্বিতীয়বার ভালোভাবে নেয়নি।

একতরফা নির্বাচনের ফলে ভোট ও মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব বেড়ে যেতে পারে। দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় বিনিয়োগ আছে। তার চেয়ে বড় ব্যাপার, ইউএসএ ও ইইউ আমাদের গার্মেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যের বৃহত্তম বাজার। তারা মুখ ঘুরিয়ে নিলে বা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা দিলে তা বাংলাদেশের জন্য সমূহ বিপদের কারণ হতে পারে। ইরাক, লিবিয়া, মিশর, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনকে পরাশক্তিধররা এক সময় খেলার মাঠে পরিণত করেছিলো। এসব রাষ্ট্রের কেউ কেউ কিন্তু আমেরিকা জোটের পরম বন্ধুও ছিল। কাধে-কাধ মিলিয়ে বন্ধু-বন্ধুভাবে খেলেছে। কিন্তু কোনো এক পর্যায়ে নানা কুটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে পরাশক্তিধররা খেলার ‘আইচা-বাটি’ গুটিয়ে, ‘মিশাইল’ ও ‘বোমা’ বৃষ্টি ফেলেছে। পরবর্তীতে এসব রাষ্ট্রের পরিণতি কি হয়েছে তা কারো অজানা নয়। এছাড়া উত্তর কোরিয়া, ইরান আর বাংলাদেশ এক কথা নয়। তারা পশ্চিমাদের বাদ দিয়ে কেবল চীন-রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে পারছে। বাংলাদেশ তা পারবে কী? বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কোনো এক দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়া ঝুঁকিপূর্ণ নয় কী?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা নতুন রেকর্ড করে টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। টানা চারবার ক্ষমতায় থাকা একটি দলের নেতাকর্মীর মধ্যে অহংকার, দাম্ভিকতা, হামবড়াই ভাব আসাটাই স্বাভাবিক। নেতা-কর্মীরা জনগণকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারেন। অনেকেই মনে করতে পারেন ক্ষমতা মানে সব কিছু আওয়ামী লীগের দখলে থাকবে। এই মানসিকতা যেন কোনভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক থাকতে হবে। নেতা-কর্মীদের উদ্যত আচরণ আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ থেকে মুক্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে ২২৩ সিট নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালি হয়নি। সরকার হিসাবে শক্তিশালি হয়েছে মাত্র। আর এতে জিতেছে সরকার, হেরেছে বাংলাদেশ, পরাজিত হয়েছে জনগণ। তাহলে এই জয় কতখানি গৌরবের? রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও খাজানা যাদের হাতে ছিলো। পরাজয়ের ভয় কেন তাদের থাকবে? কেন একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে ব্যর্থ আওয়ামী লীগ? সুষ্ঠু ভোট হলে কি এমন ক্ষতি হতো! দেশে আওয়ামী লীগ উন্নয়নমূলক যে কাজ করেছে, এবং এখনও যা অব্যাহত রয়েছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ সিটে বিজয়ী হয়ে, বুক ফুলিয়ে যে গর্ব করতে পারতো, এখন ২২৩ আসন নিয়ে সে গর্ব করতে পারছে কী? ১০০ আসন অপজিশনের থাকলেও রাজনীতি রাস্তা থেকে সংসদে চলে আসতো। তাতে দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নতির দিকে যেতো এবং ভবিষ্যতের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিজয়ের পিসফুল পসিবিলিটির পথ বের হতো নিশ্চয়ই।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী দলটির জš§লগ্ন থেকে ছোট বড় সব অর্জন গত চারটি নির্বাচনের পর আর কি বাকী থাকলো? প্রশ্ন ফাঁসে জিপিএ ৫ পাওয়ায় কী আনন্দ! এই জয়ে কোন আনন্দ আছে কী? নিজেদের মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে কোন জয়েই আনন্দ নেই। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বধানকারী দল আওয়ামী লীগ ছিল দেশের মানুষের ভরসাস্থল। অথচ কেন জানি মনে হচ্ছে, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ অন্ধকারের যুগে প্রবেশ করেছে!

রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে এত শোরগোল, ডিগবাজি ও পল্টিবাজির রাজনীতি বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও আছে কী? নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দেশসেবা করতে সবাই এতো অস্থির, উদগ্রীব, ধৈর্যহীন, বিশ্রামহীন কেন? দেশ সেবার স্লোগানের নামে এদলে সেদলে দৌড়াদৌড়ি পেছনে মূল কারণ রাজনৈতিক নয় বরং পিওর অর্থনৈতিক, এতে কোন সন্দেহ আছে কী?

লেখক: মোহাম্মদ আবু নোমান।