ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন ও বিভিন্ন অনৈতিক কার্মকাণ্ডের অভিযোগে দুই দফা বদলির পর অবশেষে রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে বরখাস্ত করা হয়। সোমবার বিকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এডিসি হারুনের বরখাস্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এদিকে হারুনের বর্বরতার শিকার ছাত্রলীগের দুই নেতার বাইরেও নতুন করে আলোচনায় এসেছেন ডিএমপির ৩৩ ব্যাচের বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তা ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম-১) সানজিদা আফরিন নিপা।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, শনিবার রাতে এডিসি সানজিদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই তার স্বামী ৩১ ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান এডিসি হারুন। ওই সূত্র জানায়, চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই সানজিদাকে বিয়ে করেন হারুন। সে তথ্য গোপন করে চাকরি নেওয়ার পর ফের বিয়ে করেন সানজিদাকে। এরপর দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়। পরে আজিজুলকে বিয়ে করেন সানজিদা। হারুনের সঙ্গে সানজিদার সেই বিয়ের ছবি বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের সেই পুরোনো সম্পর্ক ফের নতুন করে জেগে ওঠে। হারুন-সানজিদার অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি আঁচ করতে পারেন আজিজুলও। স্বভাবতই তিনি এটা মেনে নিতে পারেননি। ঘটনার দিন বারডেম হাসপাতালে হারুন-সানজিদার অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। সোমবার এ বিষয়ে জানতে এডিসি সানজিদার মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
তবে এ প্রসঙ্গে সোমবার বিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অ্যাডমিন) হাফিজ আকতার বলেন, ছাত্রলীগ নেতাকে মারধর ও বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এডিসি সানজিদার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সানজিদা মারামারি করেননি। তবে তাদের মধ্যে কোনো অনৈতিক সম্পর্ক থাকলে তা তদন্ত কমিটি দেখবে। তদন্তে এ ধরনের কোনো প্রমাণ পেলে সানজিদার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তির দায় পুলিশ নেবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এডিসি সানজিদা আফরিন নিপার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুরের নাগদা শিমলা ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন সানজিদার বাবা। তিন বোনের মধ্যে সানজিদা ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশে যোগ দেন। তার বড় বোন চিকিৎসক। সানজিদা পুলিশ ক্যাডারে চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই হারুনকে বিয়ে করেন। এএসপি হিসেবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর এডিসি হারুনকে ফের বিয়ে করেন। এরপর তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এএসপি হওয়ার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। চাকরিজীবনে বরাবরই ঢাকা বিভাগেই থাকেন সানজিদার। ওপর মহলের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় ডিএমপিতে যোগ দেন সানজিদা।
এদিকে নিজ বাহিনীর সদস্য, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী পিটিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ছিলেন এডিসি হারুন অর রশিদ। শনিবার রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈম এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ও শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিমকে পিটিয়ে আবার আলোচনায় আসেন তিনি। এ ঘটনায় এবার শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে ৩১তম বিসিএসের এ পুলিশ কর্মকর্তাকে। শনিবার রাতের ঘটনার পর রোববার তাকে ডিএমপির রমনা অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করে প্রথমে তাকে বদলি করা পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। পরে বদলি করা এপিবিএনে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, এডিসি সানজিদার সঙ্গে এডিসি হারুনের ঘনিষ্ঠতার কারণে আজিজুলের সঙ্গে স্ত্রীর দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিষয়টি অভ্যন্তরীণভাবে বেশ কয়েকবার মিটমাট করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এডিসি হারুন সরে না আসায় কোনো সুরাহা হয়নি। এরপর থেকেই দুজনকে হাতেনাতে ধরার চেষ্টা করেন আজিজুল হক।
এদিকে শনিবার বারডেমে এডিসি হারুনের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন এডিসি সানজিদা-এমন তথ্য পেয়ে আজিজুল হক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদকে নিয়ে সেখানে যান। হাসপাতালে দুজনকে একসঙ্গে দেখে ক্ষিপ্ত হন সানজিদার স্বামী আজিজুল হক। সেখানেই হারুনের সঙ্গে ওই কর্মকর্তার বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। এক পর্যায়ে সঙ্গে থাকা ছাত্রলীগের দুই নেতা বিষয়টি থামাতে গেলে হারুন শাহবাগ থানায় খবর দেন। খবর পেয়ে শাহবাগ থানা পুলিশের একটি দল সেখান থেকে ছাত্রলীগের এক নেতাকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। পরে অন্য নেতাও সেখানে যান। এরপর থানায় ওসির কক্ষে তাদের ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। হারুন নিজেও মারধরে অংশ নেন সেখানে। বেদম মারধরে অনেকটা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন নাঈম। নির্যাতনে নাঈমের বেশ কয়েকটি দাঁতও পড়ে যায়। এরপর অবস্থার অবনতি হলে তাদের রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে নাঈম এখনও চিকিৎসাধীন। তবে মুনিমের চিকিৎসার বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি।
ভুক্তভোগী আনোয়ার হোসেন নাঈম বলেন, বারডেম হাসপাতালে প্রেসিডেন্টের এপিএস আজিজুল হক খান মামুন ভাইয়ের সঙ্গে এডিসি হারুন অর রশিদের কথাকাটাকাটি হতে দেখি। তখন আমরা বিষয়টা মীমাংসা করার চেষ্টা করি। হঠাৎ এডিসি হারুন ১০-১৫ জন পুলিশ নিয়ে আসেন সেখানে। এরপর তিনি মামুন ভাই ও আমাদের ওপর চড়াও হন। এক পর্যায়ে শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিরকে মারতে মারতে তারা শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। পাঁচ মিনিট পর আমি শাহবাগ থানায় গেলে হারুনের নির্দেশে ওসির রুমে ১০-১৫ জন এসআই, কনস্টেবল আমার ওপরও পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। তিনি বলেন, থানা হচ্ছে মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু সেখানে সেবার নামে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করা হয়েছে। আমি পরিচয় দেওয়ার পর তারা আমাকে মারতে থাকে। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। তার চাকরিচ্যুতি চাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং রমনার ডিসি এ ঘটনায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কথা বলে ব্যবস্থা নেবেন বলেছেন। কিন্তু আমি তাতে ভরসা পাচ্ছি না। ছাত্রলীগ এতিমদের সংগঠন, আমাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এর সুষ্ঠু বিচার চাচ্ছি।
এদিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে মারধরের ঘটনায় সোমবার দুপুরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের সঙ্গে দেখা করেন। তারা সেখানে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করে ঘটনার বিচার দাবি করেন। এ সাক্ষাতের পর এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
দুই নেতাকে এডিসি হারুনের মারধর, মামলা করবে না ছাত্রলীগ: ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে পুলিশ হেফাজতে এডিসি হারুন অর রশিদের মারধরের অভিযোগের বিষয়ে মামলা করবে না বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।
তিনি বলেন, ছাত্রলীগ পুলিশের বিভাগীয় তদন্তের ওপর আস্থা রাখতে চায়। সোমবার ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, যে অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে এতে বাংলাদেশের সব স্তরের নেতাকর্মীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এ ঘটনার আইনি প্রক্রিয়া যেন দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয় সে জন্য আমরা রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছি। সোমবারও ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছি। ডিএমপি কমিশনার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
এ ঘটনায় কোনো মামলা করা হবে কি না এবং মামলা করতে পরিবারকে বাধা দেওয়া হচ্ছে কি না জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি জানান, তারা আপাতত ডিএমপির বিভাগীয় তদন্তে আস্থা রাখছেন।
সৌজন্যে: দৈনিক সময়ের আলো।