৫২ বছর পর আসা চিঠিতে জানা গেল বাবার খবর!

:: অমিতা সিনহা ::
প্রকাশ: ২ years ago
সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে পিতা খগেন্দ্র সিংহের সমাধির পাশি কন্যা দিপালী সিনহা। ছবি: পাবলিক রিঅ্যাকশন

বধ্য ভূমিতে হঠাৎ বাবার শেষ নিশান পেয়ে অঝোরে কেঁদে উঠলেন একমাত্র কন্যা। সমাধির পাশে বসে যেন বাবার সাথে মেয়ের হাজারো অব্যক্ত কথা বলা হচ্ছে অশ্রুবন্যায়। এমনই দৃশ্যের অবতারণা হলো সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া অবস্থায় মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার বাবা কোথায়? আমি কখনই বাবাকে দেখিনা কেন? তখন মা দু’চোখের জল বেয়ে আমাকে বলে, ‘‘১৯৭১ সালে যখন তুমি দুধের শিশু, তখন তোমার বাবার বন্ধু গৌরমোহন সিংহ ঘরে এসে তোমার বাবাকে নিয়ে চলে যায়। আমি তোমার বাবাকে বারংবার বারণ করেছিলাম যেওনা। তবুও তোমার বাবা আমার কথা শুনেনি। বলল, গিয়েই ফিরে আসবো। কিন্তু সেই যে গেলো আর ফিরে এলোনা। তোমার বাবার সাথের বন্ধুও আর আসেনি। সেই সময় পাড়া প্রতিবেশিরা বলেছে আমাকে, তোমার বাবাকে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে গাড়িতে করে নিয়ে যায় পাকবাহিনী’’। আজ দেশ স্বাধীনের বায়ান্ন বছর পর বাবার হঠাৎ চলে যাওয়ার যন্ত্রণা এক চিঠি জানান দিলো, বাবা আছে আমাদের মাঝে। লাল-সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনতে ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীদের প্রতিহত করতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছিলেন। বীরের বেশে সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে এদেশের জন্য শহীদ হয়েছিলেন বাবা (খগেন্দ্র সিংহ)। হাউ-মাউ কেঁদে জমে থাকা বুক ভরা অশ্রু সিক্ত হয়ে পিতার সংস্পর্শ না পাওয়ার যন্ত্রণা আর দেশের জন্য নিঃস্বার্থ জীবন বিলিয়ে দেওয়ার বাস্তবচিত্র তুলে ধরেন প্রতিবেদকের কাছে শহীদ খগেন্দ্র সিংহের এক মাত্র কন্যা দিপালী সিনহা।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

সিলেট শহরের সুবিদবাজারের নয়াবস্তির স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন শহীদ খগেন্দ্র সিংহ। ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতার জন্য নয়মাসের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় সুন্দরী প্রিয়তমা স্ত্রীকে পাকহানাদার বাহিনীদের হাত থেকে বাচাঁতে প্রতিনিয়ত মুখমন্ডলে কালী মেখে ঘরে রেখে রণ ক্ষেত্রে যেতেন। যাতে ওর স্ত্রী ও দুধের শিশু কন্যা নিরাপদে থাকে। আর ঘরের বিপদ আপদ মোকাবেলায় ভাইদের ঘরেই রাখতেন। ফেলে আসা ৭১’ এর দিনগুলোর কথা মেয়েকে বলেছিলেন মা (মায়া দেবী)।


স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে শহীদ খগেন্দ্র সিংহের স্ত্রী মায়া বলেছিলেন, যখন তোমার বাবাকে পাক বাহিনীরা ধরে নিয়ে চলে যায়, এরপর আর ফিরে আসেনা, তখন আমি দিনের পর দিন তোমার বাবার অপেক্ষায় থেকে দুধের শিশু(দিপালী) তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে সেলাই এর কাজ করেছিলাম। তখন সরকারি রেশনও পেতাম। তখন তুমি(দিপালী) একটু একটু হাটু ভাঙা হাঁটতে শিখেছো। মেয়েকে তিনি বলেছিলেন, ৩০ ডিসিমিলের জায়গা, বাড়ি ঘর সব সবই ছিলো। কিন্তু তোমার বাবা(স্বামী) আর ফিরে না আসায় স্বজন সহ আরও অনেকেই হস্তক্ষেপ করে সব লুটে নিয়েছে। আজ সব থেকেও আমরা নিঃস্ব।

শহীদের কন্যা প্রতিবেদককে বলেন, তখন আমিও খুব ছোট ছিলাম। তেমন একটা বোধশক্তি হয়নি। যখন আমি সরকারি অগ্রগ্রামী হাই স্কুলে পড়ি তখন আমার মা বাবার জন্য দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করেছিলো, এক সময় সেও চলে যায় অন্যত্রে। সেই সময় আমি বাবা-মাকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। এক পর্যায়ে স্বজনরা আমাকে আদর-স্নেহ করে বড় করে বিয়ে দেন। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কেউ আমার বাবা-মায়ের জায়গা সম্পতি বুঝিয়ে দেননি। সব কিছু থেকেও ভাড়া বাসায় থাকতে হচ্ছে। আমি যে আমার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সন্তান তা জেনেও ফিরে দেয়নি আমার পিতা-মাতার সই-সম্পত্তি। আমার দুই ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। ওরা পড়াশোনা করছে কলেজে। কিন্তু আজও ওদের জন্য একটা নির্দিষ্ট নিজস্ব বাড়ি দিতে পারিনি।

গত ৩ মার্চ যখন রাষ্ট্রীয় ভাবে আমার বাবা (খগেন্দ্র সিংহ) যে দেশের জন্য শহীদ হয়েছিল সেই খবর বাসায় আসে একটি চিঠির মাধ্যমে। সেই মুহুর্তে আমার শরীর মন শিউরে উঠে। শিশু বয়স থেকে মায়ের কাছে হাজারো প্রশ্ন করেও বাবার জলন্ত যে স্পর্শ কাতর প্রমাণ হাতে ধরা দেয়নি। আজ দেশ স্বাধীনের ৫২ বছর পর একটা উড় চিঠির মধ্য দিয়ে জানতে পারলাম দেশের জন্য বাবা স্ত্রী-সন্তান আর স্বজনদের রেখে চলে গিয়েছিলো। হারিয়ে গিয়েছিলো লাল-সবুজের পতাকায়। একটি ভূ-খন্ডের বিনিময়ে শহীদ হয়েছিলেন পাক হানাদারদের হাতে। জমে থাকা বুঁক ফাটা কান্নায় মূর্ছে গিয়ে কন্যা বলেন, ওরা আমার বাবাকে বধ্য ভূমিতে হত্যা করেছে।

আজ স্বাধীন দেশ খুঁজে পেয়েছে আমার বাবার (শহীদ খগেন্দ্র সিংহের) অন্তিম স্থানটির। বাবার বন্ধু শহীদ গৌরমোহন সিংহকে খুঁজে পেয়েছি সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে। খুঁজে পেয়েছি বাবার বাবা মানে আমার দাদু শহীদ আনন্দ সিংহের শেষ স্থানটিও। যারা বহুদিন ধরে হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের গবেষণা করে সম্প্রতি ৬৬ জন শহীদের আবিষ্কার করেছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। যে হারিয়ে যাওয়া বাবা-দাদু এভাবে কখন খুঁজে পাবো বলে ভাবিনি। আজ চোখের সম্মুখে মাথা উঢ়ুঁ হয়ে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দারিয়ে আছে। শহীদ খগেন্দ্র সিংহের নাতি-নাতনি দিবা ও দিপ্ত জানায়, মায়ের মুখে দাদুর গল্প আর মায়ের সংগ্রামী জীবনের অনেক গল্প শুনেছি। কখনো এমন বাস্তব চির সবুজ কাহিনী আমাদের দু’চোখে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গত ৪মার্চ চির স্বরণীয় করবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। যারা আমাদের দেশ মাতার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net