একজন ডায়নামিক লিডার শেখ জুবায়ের

::
প্রকাশ: ২ years ago
চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ইউএনও শেখ জোবায়ের আহমেদকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেন অনেকে (বামে)। এলাকাবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত জোবায়ের আহমেদ নিজেও বিদায়বেলায় হয়ে পড়েন অশ্রুসিক্ত (ডানে)।

মোহাম্মদ আবু নোমান:
এক বৃদ্ধ নারী কান্না করছেন উপজেলা চত্বরে বসে। গণমাধ্যমকর্মীরা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে বললেন, ‘টিয়ুনু বলে যাইবগু? (ইউএনও নাকি চলে যাচ্ছে)। এহন আঁরে হনে চাইবু (এখন আমাকে কে দেখবে?)’ এভাবে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের শোলকাটা এলাকার ৫০ বছর বয়সী রহিমা বেগমই নয়, কান্না করেছেন বহু মানুষ। ওই বৃদ্ধা শেষমেশ স্বাভাবিক হয়ে ইউএনওকে বিদায় দিতে পারেননি, কান্না বন্ধ করতে না পেরে।

অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের দ্বিতল ভবনে কান্নার রোল। কান্না আর পুষ্পবৃষ্টি ভেদ করে নিচে নামতেই নিজে কাঁদলেন এবং কাঁদালেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জুবায়ের আহমেদ। এ যেন একজন আপাদমস্তক ভালবাসার ফেরিওয়ালা! আনোয়ারার মাটি ও মানুষের হৃদয়ে অমরত্ব লাভ করে, সকলেরই অশ্রু টলটল চোখে রাজসিক বিদায় নিয়ে গেলেন শেখ জুবায়ের। মাত্র ৩ বছর ১১ মাসে আনোয়ারাবাসীকে এক সোনালী অধ্যায় উপহার দিয়ে গোপালগঞ্জে এডিসি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে চলে যাওয়ার দিন গত ২৪ জানুয়ারি এমনতর দৃশ্যের অবতারণা ঘটে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সরওয়ার জামান এসেছিলেন শেখ জোবায়ের আহমেদকে বিদায় জানাতে। ইউএনও থাকা অবস্থায় জোবায়ের আহমেদ চাতরী চৌমুহনী বাজারে সরওয়ার জামানকে দোকান করে দিয়েছেন। ওই দোকানের আয়েই তার সংসার চলছে।

পদোন্নতি ও বদলিজনিত কারণে কোন সরকারি কর্মকর্তা বা একজন ইউএনও এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন- যাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। প্রশ্ন হতে পারে, ইউএনও জুবায়ের কী এমন করেছেন যে, তাকে নিয়ে লিখতে হবে বা এতো আবেগী হতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে যে-কাউকে ইউএনওর বিদায় পরবর্তী গণমাধ্যমের খবর ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সর্বসাধারণের কমেন্টস- রিকমেন্টস দেখা অথবা ওই এলাকার যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই বুঝে আসবে। ঢাকার একটি প্রথমসারীর জাতীয় দৈনিকের হেড লাইন (ইউএনওর বিদায়ে এলাকাবাসীর কান্না, নিজেও কাঁদলেন জোবায়ের) দেখে চোখ আটকে গেলো। নেতিবাচক সংবাদের এ সময় এমন একজন ভালো মানুষের খবর পড়ে আবেগাপ্লুত হলাম। এ যেন অনেক অন্ধকারের মাঝে একটু আশা, একটু আলো। আহা! দেশে এমন অফিসার যদি ২০ ভাগও থাকত! দেশ ও মানুষের বড়ই উপকার হতো!

এখন রাজনৈতিক নেতা বা কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা মারা গেলেও মানুষ হাসে, খুশি হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কারো ক্ষেত্রে উল্লাস করা হয়। কারো কার্যক্রমে ঝাড়– মিছিল, বিদায়ে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। অথচ এখানে ফুল ছিটানোর বৃষ্টি, আরেক দিকে কান্নাকাটি! কিছু কান্না দেখেও আনন্দ লাগে, আর ভালো মানুষের বিদায়ে মানুষ কাঁদে, ঠিক এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আনোয়ারাবাসি।

‘অবকাঠামো নির্মাণ বা উন্নয়ন ইউএনওর দায়িত্ব নয়। আমি এগুলো করেছি নতুন কিছু করতে ভালো লাগে সে কারণে। বলা যায়, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাজগুলো করেছি। তবে এ ধরনের অবকাঠামো তৈরির জন্য মানুষ আমার জন্য কাঁদেননি, কেঁদেছেন তাদের সঙ্গে আমার যে যোগাযোগ ছিল, সে জন্য।’ বিদায়ী ইউএনও শেখ জোবায়েরের এ বক্তব্যই বলে দেয়, মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন কতটা ভালোমনের ও উদার।

আমাদের প্রয়োজন এমনি সৎ ও মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তা। যিনি শেখ জোবায়ের আহমেদের মত সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবেন। উপজেলায় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, শিশু পার্ক, দুটি নান্দনিক পুকুরঘাট নির্মাণ, উপজেলা সদরের খেলার মাঠের উন্নয়ন, গাছ লাগিয়ে পরিষদ চত্বরকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো, পাঠাগার, ব্যায়ামাগার, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, এ ধরনের বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি ও নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন শেখ জোবায়ের। এগুলো মানুষের কোনো না কোনো কাজে লেগেছে বা তাদের মধ্যে ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। এছাড়া উপজেলার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার মতো আয়োজনগুলোতে মানুষের সমর্থন পান জোবায়ের আহমেদ।

আনোয়ারা উপজেলায়তো ইউএনও শেখ জুবায়েরের আগে অনেকেই এসেছিলো। কিন্তু তার মধ্যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, উদারতা, মহানুভবতা শ্রেষ্ঠত্ব ছিলো, তার প্রমাণ আনোয়ারাবাসীর কান্না। দেশ-বিদেশে কর্মস্থলে যাওয়ার কারণে আপন ভাই-বন্ধু, ছেলে-মেয়ে বা কোনো স্বজনের বিদায়ে যেমন বুকে জড়িয়ে ধরে, মানুষ পিছু পিছু অনেক দূর পর্যন্ত এসে বিদায় দেন, শেখ জোবায়ের আহমেদের বিদায়েও তেমনই করেন আনোয়ারা উপজেলার অনেক বাসিন্দা। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের এমন ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে শেখ জোবায়েরও আবেগ শাসলাতে না পেরে নিজেও কেঁদেছেন। বিদায়ের সেই ভিডিও ও ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘুরছে। হাজার-হাজার সর্বসাধারণ ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও জোবায়ের আহমেদের বিদায়ে কেন কেঁদেছেন বা অন্যরা কেঁদেছেন, সে কথা লিখেছেন। আমরা বলবো, এ-ই সততা, এ-ই নিষ্ঠতা, এ-ই একজন কর্মযোদ্ধা। মানুষকে ভালবাসতে এবং মানুষের থেকে ভালোবাসা পেতে মানবিক হৃদয় লাগে। একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বিদায়ে এমন মুহূর্ত আসে বা হয়, তা আমাদের দেশের পেক্ষাপটে পাওয়া বিরল।

অসংখ্য মানুষের ভালবাসা নিয়ে কর্মস্থল হতে বিদায় নিতে পারা ভাগ্য ও যোগ্যতার বিষয়। জোবায়ের সাহেবকে অভিনন্দন! প্রতিটি উপজেলার ইউএনও যদি এমন হতো তাহলে তো পুরো বাংলাদেশের চেহারাই বদলে যেতো। আশা করি একদিন হবে। একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওই উপজেলার মানুষদের কতটুকু ভালোবাসলে বিদায় বেলায় এরকম কান্না করে, তা আমাদের জানা নেই। আসলে শেখ জোবায়ের তার আপন যোগ্যতায় আনোয়ারাবাসীর মন জয় করেছেন।

দুর্নীতি-লুটপাটের জ্বরে আক্রান্ত গোটা দেশকে বাঁচাতে হলে এমন দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদেরই আজ বড় বেশি প্রয়োজন। এটা সত্য দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব ও দায় অনেক বেশি। কিন্তু হঠাৎ করে আসমান থেকে ভাল মানুষ আসবে, দেশ ভাল হয়ে যাবে, এই অবাস্তব কল্পনা ঠিক নয়। দেশ ভাল হতে হলে আমাদের বেশিরভাগ মানুষকেই যার যার জায়গা থেকে ভাল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনোয়ারা উপজেলায় ইউএনও হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন শেখ জোবায়ের আহমেদ। শেখ জোবায়ের আহমেদের নেতৃত্বে তিন বছরে দু’বার জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রমে দেশসেরা উপজেলা হয়েছে আনোয়ারা। ইউএনওর বিভিন্ন সৃজনশীল পরিকল্পনা প্রসঙ্গে আনোয়ারা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফেরদৌস হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, শেখ জোবায়ের একজন ‘ডায়নামিক লিডার’ ছিলেন। জন্মনিবন্ধন প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে গণমাধ্যমে কোনো কোনো শিশুর মা বলেছিলেন, ‘সন্তান জন্ম দেওয়া যতটা না কষ্টের, তার চেয়ে বাচ্চার জন্মনিবন্ধন করা বেশি কষ্টের।’ জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রমে দেশসেরা উপজেলা হওয়ার পেছনেও সম্মিলিত উদ্যোগ ছিল বলে উল্লেখ করে জোবায়ের আহমেদ বলেন, তিনি যখন ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন এ কার্যক্রমের সফলতার হার খুবই কম ছিল। ইউনিয়ন পরিষদ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা এ কাজের সঙ্গে জড়িত। ইউএনও হিসেবে তিনি নেতৃত্ব ও কাজের সমন্বয় করেছেন। আগাম জন্ম তথ্য জেনে হবু মাকে চিঠি লেখা, নবজাতককে টিকা দিতে আসার পর পরবর্তী টিকা নিতে হলে জন্মনিবন্ধন কার্ড লাগবে, এটি বলে দেওয়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমামদের মাধ্যমে মসজিদে বিষয়টি জানানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।

জানা যায়, ইউএনও হিসেবে শেখ জোবায়ের আহমেদ যখন দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন তার হাসিমুখ দেখে সবাই ভরসা পেতেন, কথা বলার সাহস পেতেন। শেখ জোবায়ের বলেছেন, ‘একজন ইউএনওর কাছে মানুষ কিছু প্রত্যাশা নিয়ে আসেন। আমার সঙ্গে সবাই কথা বলতে পেরেছেন। আমি মানুষের কথা শুনেছি। ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপেও অনেকে যোগাযোগ করেছেন। আমি চেষ্টা করেছি মানুষের ভোগান্তি কমাতে। ইউএনও হিসেবে কাজের দায়িত্বের বাইরেও মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। কেউ হয়তো পাসপোর্টসংক্রান্ত ঝামেলায় আছেন, পাসপোর্ট অফিসে আমার কেউ পরিচিত থাকলে তাকে সমস্যাটি সমাধানের অনুরোধ করেছি। এভাবেই মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।’

করোনা মহামারির সময় সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি তিনি মানুষের মনে সাহস দিয়েছেন। করোনার সময় তিনি আঞ্চলিক ভাষায় এক ভিডিও বার্তা দেন, যা মানুষ খুব পছন্দ করে। ‘আনোয়ারার সবার জ্বর সারলে তিনি বাড়িতে যাবেন’। এটাও মানুষ ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল। তিনি করোনার টিকা গ্রহীতাদের ফুল আর নাশতার প্যাকেট দিয়ে প্রশংসিত হন। ওই সময় শেখ জোবায়ের আহমেদ তিনবার করোনায় আক্রান্ত হয়েও হাল ছাড়েননি। নিজ যোগ্যতাগুণে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন আনোয়ারার পথে প্রান্তরে। কর্মদক্ষতায় এভাবে ইউএনও শেখ জোবায়ের আহমেদ উপজেলার সর্বস্তরের জনসাধারণের মানুষের মন জয় করার সাথে পেয়েছেন দুবার দেশসেরার স্বীকৃতি।

এই মহানুভবতার পেছনে অনুপ্রেরণা ছিলো তার পিতা-মাতা ও স্ত্রী শারমীন আরার। যিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক, বর্তমানে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। এলাকায় অন্যান্য কিন্ডারগার্টেন স্কুল বা ভালো স্কুল থাকতে ছেলে-মেয়েদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ানোর বিষয়ে ইউওনো জোবায়ের বলেন, তার মা জোবাইদা আখতার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। জোবায়ের নিজেও প্রাথমিক বিদ্যালয়েই পড়াশোনা করেছেন। তাই তিনি ও তার স্ত্রী চেয়েছেন, ছেলে-মেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়েই পড়াশোনা করবে। এভাবে আমাদের প্রতিটি ঘরে ঘরে যদি সভ্যতা সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের লালন হয়, তাহলে এই দেশ এই সমাজ বদলে যাবে।

একথা ঠিক যে, দেশের নানা প্রান্তে নানা পেশায় এমন অল্প কিছু জোবায়ের হয়তো আছে। কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ কর্মকর্তা কেন জোবায়েরের মতো হয় না? কেন তারা সবাই এমন ভালোবাসা পাওয়ার মতো কাজ করে না? কেন অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগ ওঠে? কেন তারা টাকা আর ক্ষমতা চায়, ভালোবাসা পেতে চায় না? তাহলে তো এই দেশের চিত্রটা বদলে যেত!


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। আপনিও লিখুন।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net