উন্নয়নের সার্কাস দেখতে চাই না

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ২ years ago

ভেঙে পড়লে, ধসে পড়লে, হেলে পড়লে, ডুবে গেলে, আগুন লাগলে, কিংবা ধরা পড়লে চিত্রনাট্য শুরু হয়। অনুমোদন ছিল না, ফিটনেস ছিল না, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, ফায়ার সেফটি ছিল না, ইত্যাদি ইত্যাদিৃ। দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্টরা আগে কী করেন? রাজউক ও স্বাস্থ্যের কর্মকর্তা বাদ, সাধারণ কর্মচারী ও গাড়িচালকরাও শতকোটি টাকার মালিক। রাজধানীতে নামে-বেমামে ফ্ল্যাট-গাড়ি এসব আসে কোথা থেকে? কর্মচারীদের এত এত সম্পদ, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তারা কিছুই জানেন না, বোঝেনও না? পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের ম্যানেজমেন্টের অ্যাটেনশনে যে ভবন হচ্ছে এবং তা যদি এভাবে ভেঙে পড়ে, তাহলে এই বিজ্ঞানীরা যদি পরমাণু বোমা বানান, সেটা দিয়া ‘মৌচাক ভাঙা’ যাবে কি না, সেখানেও সন্দেহ থেকে যায়। এর আগে আমরা রডের বদলে ‘বাঁশবান্ধব’ উন্নয়ন দেখেছি! এখন কি বাঁশের বদলে কঞ্চি ব্যবহার করা হয় যে, খুশির ঠ্যালায় ভেঙে গেল? সোনার বাংলায় উন্নয়নের সার্কাস আমরা দেখতে চাই না। রাজধানীতে গত এক যুগে অন্তত ১৪টি ভবনধস ও হেলে পড়ার ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের, আহত হন শতাধিক ব্যক্তি।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই নির্মাণাধীন ভবনের দশম তলার ছাদের বেশিরভাগ অংশ ধসে পড়ে, যাতে অন্তত ১৬ জন আহত হন। গত ১০ মার্চ ধসে পড়া বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন ভবনটি পরিদর্শনে এসে স্বয়ং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, ভবনটির নির্মাণকাজে গাফিলতি ছিল। আমরা বলতে চাই, সেই গাফিলতির দায় কার, কতটুকু? তদন্ত কমিটি করা হয়েছে কি নাÑগণমাধ্যকর্মীদের প্রশ্নের জাবাবে ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘আমরা সবকিছু দেখলাম। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা হবে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভবন।’ মন্ত্রী মহোদয় (যিনি একজন স্থপতিও) বললেন, ‘এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভবন’ অথচ ভবনটি নির্মাণে রাজউক থেকে কোনো অনুমোদনই নেয়া হয়নি। পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এই হাল? ভাবতেই তো গা শিউরে উঠছে! এত গুরুত্বপূর্ণ ভবন, অথচ নির্মাণের অনুমোদনই নেই! রাজউক ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানান, সাভারের ওই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের অনুমোদন বা মতামত নেয়া হয়নি। পরমাণু শক্তি গবেষণা কমিশন তাদের নিজস্ব পরামর্শকের মাধ্যমে নকশার কাজটি করেছে। নিজস্ব পরামর্শক দিয়ে কাজ করলেও পরমাণু শক্তি গবেষণা কমিশনের উচিত ছিল স্থাপত্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে যাচাই করে নেয়া। কিন্তু সেটিও তারা করেননি।
বাহ! কত চমৎকার কথা! সবকিছু ঘটার পর আপনারা জানেন, অনুমোদনহীন ছিল! রাজউকের কাজ এটাই, কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হলে সেই বিল্ডিংয়ের অনুমোদন নেই সেটা বলা? কিন্তু তার আগে কোনো কোনো বিল্ডিং ২০-৩০ বছর চোখের সামনেই ছিল, তখন কি তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকেন? এত বড় (র‌্যাংকস ভবন, হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন, হাটখোলায় এফবিসিসিআইয়ের বহুতল ভবন, সাভারে রানা প্লাজা, গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ) বিল্ডিংগুলো নানা অনিয়মের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল, আর সেটা যাদের দেখার কথা তারা কিছুই দেখতে পেল না? তাছাড়া পরমাণু শক্তি কমিশনের বিল্ডিং কারও বেনামের সম্পত্তি নয়, তাতেও এই অবস্থা! তার মানে সরকার নিজেই নিজের নিয়মকানুন মানে না।
ভবনমালিকেরা অবৈধ ও ত্রুটিবিচ্যুতি রেখে ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিচ্ছেন, অথচ ভাড়াটেরা উচ্চ ভাড়া দিয়ে থাকলেও জানতে পারছেন না ভবনটি অবৈধ কি না, কতটা মজবুত। লঞ্চ দুর্ঘটনার পরে জানা যায় ফিটনেস সনদ ছিল না, গাড়ি দুর্ঘটনার পরে জানা যায় চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। সবকিছু কেন ঘটে যাওয়ার পরে নজরে আসে? বাস, ট্রাক, লঞ্চ, বিল্ডিং, যেখানেই দুর্ঘটনা ঘটে, সবখানেই এ কমন ডায়ালগ শোনা যায়! সবসময়ই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার পর নিয়ন্ত্রণ বা মনিটরিং সংস্থার ঘুম ভাঙে।
যতই দুর্নীতির জিরো টলারেন্স ঘোষণা দেয়া হোক না কেন, ছাদ ধসিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে তারা (দুর্নীতিবাজরা) বারবার প্রমাণ করছে, তারা মরেনি বা বংশ পরম্পরায় মরবে না কোনোদিনই এ বাংলাদেশে।
আমরা বলতে চাই, সরকারি কোনো সংস্থার অনুমোদন না নিয়ে কীভাবে পরমাণু শক্তি কমিশন ভবন নির্মাণ করছে? এটা অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত নয়কি? এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে কি আইন না মানতে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে না? যে দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান আইন মানে না, সে দেশে সাধারণ জনগণের কথা বলাই বাহুল্য। রাজউকের আওতাধীন এলাকায় কত ভবন অনুমোদনহীন, তা রাজউক জানে কি? ঢাকায় ভবনের ঝুঁকি নিরূপণে জরিপ পরিচালনা ও তালিকা তৈরির দায়িত্বও সংস্থাটির। কিন্তু সেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকাও তাদের প্রকাশ করতে হবে।
পরমাণু শক্তি কমিশনের নির্মাণাধীন ভবনটির অবস্থান সাভারের গণকবাড়ী এলাকায়। এলাকাটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অঞ্চল-১-এর আওতাধীন এবং সংস্থাটির প্রণয়ন করা ঢাকা মহানগর এলাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) অন্তর্ভুক্ত। প্রচলিত ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে, ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত কোনো এলাকায় যেকোনো ধরনের ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউক থেকে অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।
পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দশতলা পর্যন্ত নির্মাণ হয়ে গেল অনুমোদন ছাড়াই? আসল জায়গায় হাত দিতে হবে। শেকড়ে সমস্যা। যক্ষ্মা যার হয়েছে, তাকে জ্বর কমানোর জন্য নাপা খাইয়ে লাভ আছে কি? রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ীতে ২০১০ সালের জুন মাসে একটি পাঁচতলা ভবন ধসে পড়ে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। পরে জানা যায়, জলাশয়ের নরম মাটির ওপর কোনো ধরনের পাইলিং ছাড়া ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
সম্প্রতি ভূমিকম্প নিয়ে সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, ঢাকায় ধসে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ৯ লাখ ভবন। টাঙ্গাইলের মধুপুরে মাটির নিচে যে চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইন রয়েছে, সেখানে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় আট লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় এ ভূমিকম্প হলে মারা যাবে দুই লাখ ১০ হাজার মানুষ, আহত হবে দুই লাখ ২৯ হাজার। সম্প্রতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক সমীক্ষায় এই ঝুঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, মধুপুর চ্যুতিরেখায় ওই মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দুই লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার সমান। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নিমাণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে প্রায় চার লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা।
রাজধানীতে স্থাপনা নির্মাণে প্রথমত ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্মাণ অনুমোদন নিতে হয়। এরপর নির্মাণ শেষে বসবাস করার জন্য বসবাস সনদ বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে হয়। এসব ছাড়া ভবন নির্মাণ হচ্ছে কি না, তা দেখাও রাজউকের দায়িত্ব। পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ রাজউকের মূল দায়িত্ব। এই দু ক্ষেত্রেই সংস্থাটি ব্যর্থ। নিয়মের ব্যত্যয় করে ভবন হচ্ছে, কিন্তু সেটি তদারকি হচ্ছে না। এর পেছনে দুর্নীতি বড় কারণ। রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা অংশ লাভের গুড়ের আশায় জনগণের জীবনকে হুমকিতে ফেলছে।
স্কুল হবে আনন্দের, শিক্ষার প্রতি উৎসাহমুখী। সে অনুযায়ী তৈরি হবে স্কুলভবনও। সেখানে যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়, তাহলে সে শিক্ষা কি আনন্দ ও উৎসাহমুখী হওয়া সম্ভব? নতুন ভবন পেয়ে শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থীসহ সবার মধ্যেই আনন্দ বিরাজ করবে। কিন্তু পরে ভবনের জরাজীর্ণ অবস্থা তৈরি হলে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বৃষ্টির সময় ছাদ দিয়ে শ্রেণিকক্ষের ভেতরে পানি পড়ে শিক্ষার্থীদের বই-খাতা পর্যন্ত ভিজে যায়। যেভাবে মানুষের নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে, পুরো দেশটাই একদিন এভাবে ধসে পড়বে! অনিয়ম-দুর্নীতি সীমা অতিক্রম করলে যা হয়। উন্নয়ন ধসে পড়ার জন্যও একটি গবেষণা কেন্দ্র দরকার বলে আমরা মনে করছি।
এছাড়া উদ্বোধনের আগেই ক্যানেল বা খালের ওপর নির্মিত সেতুর স্প্যানে/কালভার্টে ফাটল, উদ্বোধনের আগেই নবনির্মিত বিদ্যালয়ের ভবনে ফাটল, ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়ম, ছাদ চুইয়ে বৃষ্টির পানি পড়া প্রভৃতি লিখতে গেল বড় একটি কিতাব হয়ে যাবে। এসব গাফিলতি বা অনিয়মের জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না বলেই আজ সারাদেশের বেশিরভাগ বিদ্যালয় ভবনের করুণ অবস্থা। শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকিতে। শিক্ষা খাতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও তার বড় অংশ অপচয় হয় দুর্নীতির কারণে। গত কয়েক বছরে ভবন ধসে শিক্ষার্থী হতাহতের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অনিয়ম ও গাফিলতির জন্য কেউ শাস্তি পেয়েছেন, এমনটা শোনা যায়নি।
রাজউকের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, সংস্থাটির রূপকল্প হলোÑ‘স্বাস্থ্যকর ও বাসযোগ্য রাজধানী গড়ার প্রত্যয়ে গঠিত সর্বোচ্চ পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ।’ তবে যুক্তরাজ্যের ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ২০২২ সালের সূচকে বাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৭২টি শহরের মধ্যে ১৬৬তম। এর ওপর আমরা আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
সম্প্রতি রাজধানীর পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণে ২৪ জনের মৃত্যুর পর জানা যায়, পাঁচতলার অনুমোদন নিয়ে ভবনটি সাততলা বানানো হয়। রাজউক ওই ভবনের মূল নকশাসহ অন্য নথিপত্র খুঁজে পায়নি। তবে ভবিষ্যতে কেউ যদি আবার সাভারের রানা প্লাজা ভবনের উদাহরণ টেনে পরমাণু শক্তি গবেষণা ভবনেও ঝাঁকুনি দেয়ার ষড়যন্ত্র করেÑসে আশঙ্কা রয়েই গেল।

লেখক: মোহাম্মদ আবু নোমান
ইমেইল: abunoman1972@gmail.com


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net