ঈদ ঘিরে সব আয়োজন স্বস্তিদায়ক হোক

::
প্রকাশ: ২ years ago
বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনের ফাইল ছবি

মানুষের জীবনে প্রতিটি দিন যেন ঈদের আনন্দ নিয়ে আসে, এটাই ঈদের শিক্ষা। কিন্তু ঈদ আনন্দকে উপভোগ করার জন্য ঈদ প্রস্তুতির ধাপগুলো মসৃণভাবে অতিক্রম করা অনেক ক্ষেত্রেই সহজসাধ্য হয় না। এই তো কয়েকদিন আগে প্রায় ছয় হাজার দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেল। দিশেহারা হয়ে গেছেন দোকান মালিক ও কর্মীরা। তাদের কষ্ট, বুকফাটা ক্রন্দন সহ্য করার মতো নয়। তারপরও এসব নিয়েই আমাদের ঈদ উদ্যাপন করতে হচ্ছে। এ বঙ্গবাজার দেশের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের পোশাকের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।

আমরা যত উপরে উঠছি, মনে হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ও ভোগান্তি যেন ততই পিছু নিচ্ছে। কত দিন, কত বছর পার করলে স্বস্তিকর ও নিরাপদ ঈদ প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারব? ঈদ সামনে রেখে প্রতিবছর যে বিষয়গুলো দেশের মানুষকে হয়রানির মধ্যে ফেলে, সেগুলো একটু আলোচনা করা যাক।

এ সময় রাজধানী ও অন্যান্য শহরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধী বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ চক্রের মধ্যে রয়েছে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, পকেটমার। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও অধিকাংশই থাকে অধরা। বাস-ট্রেন-লঞ্চ স্টেশন, মার্কেট-বাজার হলো এদের টার্গেট এরিয়া। এদের কবলে পড়ে খোয়া যাচ্ছে অনেকের টাকাপয়সা, মোবাইল ফোন, মানিব্যাগসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা জনসমাগম স্থানগুলোতে ফেরিওয়ালা ও পাবলিক পরিবহণে যাত্রীবেশে ডাবের পানি, চা-কফিসহ বিভিন্ন পানীয় ও খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক, রুমালের সঙ্গে ক্লোরোফর্ম মিশিয়ে মানুষকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। এদের পাল্লায় পড়ে কত ট্রেনযাত্রীকে হাসপাতালের বেডে ঈদের সেমাই খেতে হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া চেতনানাশক ওষুধ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও যেসব অসাধু ওষুধ বিক্রেতা অধিক মুনফার জন্য অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের কাছে চেতনানাশক ওষুধ বিক্রি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে ছিনতাইকারী চক্র। শহর-বন্দরে নিরিবিলি জায়গায় একা পেয়ে টাকাপয়সা, মোবাইল ইত্যাদি ছিনতাই করে দ্রুত কেটে পড়ে তারা। পকেটমাররা এ সময়টির অপেক্ষায় থাকে সারা বছর। ঈদ সামনে রেখে সারা দেশে, বিশেষত রাজধানীতে জালনোট চক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আসল নোটের মাঝে জালনোট মিশিয়ে সাধারণ মানুষকে ফতুর করে ছাড়ে তারা।

ফুটপাত দখল করে জুতা-স্যান্ডেল, কাপড়চোপড়, ফল-ফুল বিক্রি ঈদের মাসে ভিন্নরূপ ধারণ করে, ফলে রাস্তা দিয়ে হাঁটা কঠিন হয়ে পড়ে। ফুটপাতের দোকানদার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, এমনকি ভিক্ষুকের কাছ থেকেও চাঁদা তুলতে চাঁদাবাজরা কসুর করে না। আর দোকানিরাও জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে প্রকারান্তরে জনগণের পকেট থেকে চাঁদার অংশটুকু সমন্বয় করে নিচ্ছে। এসব জালিয়াত চক্রের সদস্য, ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের শুধু গ্রেফতার করলে হবে না, তাদের বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ঈদ সামনে রেখে দেশের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরির অবৈধ অনেক কারখানা গড়ে ওঠে। গোপনে পরিচালিত ওইসব কারখানাগুলোতে অস্বাস্থ্যকর ও অপরিষ্কার পরিবেশে মান-নিয়ন্ত্রণের তোয়াক্কা না করেই চলতে থাকে সেমাই উৎপাদন এবং পোড়া মবিলে ভাজা হতে থাকে লাচ্ছা সেমাই। জনগণকে ভেজাল ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য গ্রহণ থেকে পরিত্রাণ দিতে হলে খাদ্য উৎপাদক, প্রক্রিয়াজাতকারক ও পরিবেশকদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে এবং বোধকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, দই, বিভিন্ন মিষ্টান্ন দ্রব্য, ফুচকা তৈরির অবৈধ, অস্বাস্থ্যকর সব ফ্যাক্টরি উচ্ছেদ করতে হবে। ঈদের প্রাক্কালে আমাদের প্রতিজ্ঞা হতে পারে-ভেজালমিশ্রিত খানা, আর না, আর না। খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণকারীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের মেধাহীন, রুগ্ণ ও অসুস্থ জাতিতে পরিণত হতে হবে। অসুস্থ জাতির কাছ থেকে কখনোই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি আশা করা যায় না।

বিগত কয়েক বছরের হিসাব বলছে, প্রায় ৬০-৭০ লাখ মানুষ ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি বা অন্যত্র যায় ঈদ উদযাপনের জন্য। টিকিট সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছা, পদে পদে ভোগান্তি। বাস, লঞ্চ, ট্রেনের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ৩-৪ গুণ যাত্রী নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল আমাদের গা সয়ে গেছে। লাইসেন্সহীন চালকের মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসবিহীন বাস, লাইট-ফ্যানহীন পুরোনো জরাজীর্ণ ট্রেনের বগি ঈদযাত্রীদের আদরণীয় বাহনে পরিণত হয়। যাত্রাপথের ধকল ও ক্লান্তিতে পানসে হয়ে যায় ঈদ আনন্দ। তাই যাদের বাড়ি যাওয়ার পিছুটান বিভিন্ন কারণে একটু আলগা, জার্নির ভোগান্তি বিবেচনা করে তারা ঈদ মুভমেন্টকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।

প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়া লক্কড়ঝক্কড় লঞ্চের মেঝে ও কার্নিশে লোহার পাত লাগিয়ে, নতুনভাবে রং মেখে ঝকঝকে করে ঈদযাত্রীদের জন্য পানিতে নামানো হয়। দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে নাড়ির টানে বাড়িমুখী যাত্রীদের সেটাই বরণ করে নিতে হয়। ঈদে লঞ্চডুবির ফিরিস্তি কিন্তু ছোট নয়। নদীপথের ঈদযাত্রা নিরাপদ করার জন্য চলাচলের অনুপযোগী লঞ্চগুলোকে কোনোভাবেই চলাচল করতে দেওয়া উচিত নয়। এজন্য তদারকির ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এটাই অবশ্য প্রথম ঈদ। তাই এবার দক্ষিণবঙ্গের মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে লঞ্চ যাত্রা করবেন না, এটাই প্রত্যাশা।

উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের ভেতরে বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব ও যাত্রাপথের সময়কে সমন্বয় করতে হবে। নব্বইয়ের দশকে মগবাজার বা মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গাজীপুর শহরে পৌঁছাতে সময় লাগত সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট। এখন সেটা ৩-৪ ঘণ্টার যাত্রাপথে পরিণত হয়েছে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের যাত্রাপথ ছিল দুই ঘণ্টার, এখন সেটা বেড়ে ৪-৫ ঘণ্টায় ঠেকেছে। মহাসড়কে যানজটের অসংখ্য কারণের মধ্যে ভাঙাচোরা রাস্তা, গাড়ির অতিরিক্ত চাপ, রাস্তার সংযোগস্থলগুলোয় এলোপাথাড়ি গাড়ি রাখা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা অন্যতম। ঈদের সময় যানজট সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। মহাসড়কগুলোর যেসব সংযোগস্থলে সবসময় যানজট লেগে থাকে, সেসব স্থানে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা যেতে পারে। রাস্তাগুলো মানসম্মতভাবে তৈরি করতে হবে, যেন দুদিন পরপর নষ্ট হয়ে যানজট ও জনভোগান্তির কারণ না হয়।

গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে যখন কোনো হেলপার বসে, তখন দুর্ঘটনার আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়। ঈদের আগের দিন থেকে পরবর্তী কয়েকটা দিন ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর প্রায় ফাঁকা থাকে। যানজট থাকে না। শহরজুড়ে স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করে। আর এ সময়ে ধনীর দুলালেরা বাবার গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অনেকেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পাগলা ঘোড়ার মতো গাড়ি চালায়, যানবাহনহীন ফাঁকা রাস্তায় ফুটপাথ, দোকানপাট, পথচারীর ওপর গাড়ি তুলে দিয়ে যানমালের ক্ষতির কারণ হয়, প্রাণহানি ঘটায়। কয়েক বছর আগের ঘটনা, ঈদের পরদিন ভোরবেলা এক বয়স্ক দম্পতি মেয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য সিএনজির অপেক্ষায় ফুটপাথে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন সময় প্রচণ্ড গতির একটি প্রাইভেট কার তাদের ওপরে আছড়ে পড়লে ঘটনাস্থলেই দুজনের মৃত্যু হয়। পরে দেখা যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন এক মাতাল তরুণ বন্ধু-বান্ধবসহ ফুর্তি করতে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল। শহরে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণকারীদের ঈদ-পরবর্তী সময়গুলোয় আরও কঠোরভাবে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। একই সঙ্গে অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের শাসন করা, নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখা দরকার, ফাঁকা রাস্তায় দুঘর্টনার হার অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। তাই গাড়ি কে চালাচ্ছে, সে প্রকৃত ড্রাইভার কি না, মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছে কি না-রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে এ বিষয়গুলো পরীক্ষা করার ব্যবস্থা না নিলে ঈদে দুর্ঘটনার হার কমানো যাবে না। তাই ঈদযাত্রা নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে হেলপার, অপ্রাপ্তবয়স্ক, লাইসেন্সহীন কেউ যেন স্টিয়ারিংয়ে বসতে না পারে, তা এখন থেকেই মনিটর করতে হবে। ফিটনেসবিহীন পুরোনো সব ধরনের যানবাহন সড়ক-মহাসড়ক থেকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

আমরা কজন জানি লাক্সারি বাসের একেকজন ড্রাইভার একনাগাড়ে কয়টি ট্রিপ দেন? তারা নাকি একটানা ৩-৪টি ট্রিপ দেন। অর্থাৎ টানা ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে স্টিয়ারিং ধরে রাখেন। এরকম পরিস্থিতিতে তার ক্ষণিক অন্যমনস্কতার জন্য যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তাকে কি খুব বেশি দোষ দেওয়া যায়? এ বিষয়টি নিয়ে মালিক ও ড্রাইভার সমিতি এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের আলোচনা করা ও সিদ্ধান্তে আসা দরকার। আমাদের দেশে ট্রেন, বাস, লঞ্চ, সর্বোপরি যাত্রাপথে দুর্ঘটনার হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বাস, ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ আর চলতে দেওয়া যায় না। জানমালের নিরাপত্তা বিবেচনায় আমাদের এ ব্যাপারে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে।

আমাদের দেশে রাস্তাঘাটসহ আনুষঙ্গিক ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটেছে এবং যাত্রীবান্ধব যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। নাগরিক সেবাগুলো দ্রুততার সঙ্গে মানসম্মত ও যথাযথভাবে পরিবেশিত হচ্ছে। তাই ঈদ প্রস্তুতিকে আরও স্মার্টলি হ্যান্ডেল করতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজাতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার অগ্রযাত্রায় প্রাপ্ত অর্জনগুলোকে আরও মজবুত করার মাধ্যমে স্বস্তিকর ঈদসেবা প্রদানে আমাদের সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।

লেখক: সালাহ্উদ্দিন নাগরী; সরকারি চাকরিজীবী।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net