মুসলমান সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ঈদুল ফিতর অন্যতম। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্নশাখায় রোজার ঈদ আপন বিভায় সমুজ্জ্বল।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁর লেখায় ইসলাম ধর্ম বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন এবং বিচিত্রমাত্রিকতায় অনন্য।
বলা বাহুল্য, বহু বিচিত্র বর্ণ -বিভঙ্গে উৎসারিত হয়েছে নজরুল -প্রতিভার দুরন্ত নির্ঝর। বিদ্রোহ, বিপ্লব, সমাজ চেতনা, প্রেম, মানবমুখিনতা, প্রকৃতি প্রীতি, অসাম্প্রদায়িক মনোভঙি ইত্যাদি ইত্যাদি অনুষঙ্গ তাঁর সাহিত্য- ভুবনে হিরণ্ময় উৎসারে উৎসারিত। এরসাথে নিবিড় অধ্যাত্মবোধ নজরুলের সাহিত্যকে করেছে কালজয়ী। এ বলয়ে নজরুল – সাহিত্য অত্যন্ত চিত্তরঞ্জী।
তিনি ইসলামি সংগীতধারার প্রথম সফল প্রবর্তক। ইসলামের বিভিন্ন বিষয় তাঁর সাহিত্য-সাগরে সুধাগন্ধে হিল্লোলিয়া ওঠেছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সংগীত -গবেষক করুণাময় গোস্বামীর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, “ভক্তি, শরণাগতি ও মাহাত্ম্যবোধের প্রেরণাথেকে নজরুল ইসলাম ধর্ম সম্পৃক্ত বিষয় অবলম্বনে দুই শতাধিক গান রচনা করেন। এইসব গান নজরুল ইসলামের ইসলামী গান রূপে খ্যাত…।
বাংলা কাব্য সংগীতের সমুন্নতধারায় ইসলামী ভক্তিগীতি রচনার ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম পথিকৃৎ ভূমিকা পালন করেছিলেন ।”১
নজরুলের বিচিত্র বিপুল সংগীত সম্ভারে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে ঈদুল ফিতরের মহিমা দিব্যরাগে বিভাসিত। এ ধারায় ঈদ বিষয়ক সংগীতমালার মধ্যমণিরূপ, ‘ও মন রমজানের ‘…গানটি আমাদের আলোচ্য বিষয়।
ইসলামি সংগীতধারার সফল প্রবর্তক নজরুল, একথা বোদ্ধা -সারস্বত সমাজ কর্তৃক দৃঢ় কণ্ঠে স্বীকৃত। এক্ষেত্রে পল্লীগীতিসম্রাট আব্বাস উদ্দিনের হার্দিক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁর প্রেরণায় নজরুল গানটি রচনা করেন। সুর সংযোগ করে তাঁকে গানটা শিখিয়েও দেন। আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে এইচ এম ভি থেকে রেকর্ডকৃত গানটি প্রচারের সাথে সাথে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সংগীত-জগতে জাগে সুদূর প্রসারী আলোড়ন।মুসলমানদের ঘরে ঘরে প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত জোয়ার জাগে। নানামুখি কল্যাণচিন্তার অমৃত-হিল্লোলে ঘুমন্ত মুসলিম সমাজ হতে থাকে সরস, সজীব, সপ্রাণ ।
উজ্জীবনের মোহনীয় বাঁশির সুরে মুসলমান সমাজের বোধ, বুদ্ধি সর্বোপরি প্রেরণার বন্ধ্যা বাগানে হাজার বসন্তের ফুল ফুটতে থাকে।
নিস্তরঙ্গ বেলাভূমে শোনাযায় জোয়ারের স্বতঃস্ফূর্ত গুঞ্জন। দেখা নতুন জীবনের সুবর্ণরেখা।
তখন মুসলমানদের মন মনন অমেয় ঐশ্বর্যের রূপানুধ্যানে দুরন্ত দুর্বার হতে থাকে ।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক পত্রিকা’ চক্রবাক’ এ প্রকাশিত শাহিনুর রেজা রচিত প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, “কাহারবা তালে নিবদ্ধ ‘জুলফিকার ‘গ্রন্থভুক্ত শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ সালে এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত গানটির রেকর্ড নং এন ৪১১১। ঐ সময় কলকাতায় ম্যাডান থিয়েটারের প্রধান নাট্যকার ও গীতিকার ছিলেন কাশ্মীরের জনাব আগা হাশার। এই আগা হাশার রচিত একটি বিখ্যাত গজল গান হচ্ছে,
‘ হায় জায়েঙ্গে ওয়াহাঁ খুশ দিলে দিওয়ানা যাহাহো ‘।
নজরুল এই গানের সুরে ও ছন্দে বাংলায় ইসলামী গান রচনা করলেন, ও ‘মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। ‘( সূত্র ইসলামী ঐতিহ্যে নজরুল -সংগীত, আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউ, পৃষ্ঠা ৮ ।)”২
ঈদুল ফিতরের মাহাত্ম্য ও মর্মবাণী
তথা শান্তিরধর্ম ইসলামের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল এ সংগীত আব্দুল আজিজ আল আমান সম্পাদিত নজরুল-গীতি অখণ্ড গ্রন্থে সংকলিত। পৃ২১৪, গান নং ৯৯০।
এখানে ঈদের ঝিলিমিলি খুশির সাথে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন সাম্যের কবি নজরুল, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ।”
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হলো জাকাত। ধর্মীয় রীতি মোতাবেক জাকাত প্রদানের বিষয়ে কবির সুরেলা আবাহন এ গানে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে,
“দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ। ”
এ সংগীতে নজরুলের ধর্মীয়চেতনা অত্যন্ত সুগভীর, তাৎপর্যপূর্ণ, চিত্তরঞ্জন এবং শিল্পঋদ্ধ।
পবিত্র রমজানের কঠোর সাধনার শেষে বাঁকা চাঁদের পানসি চড়ে আনন্দ উল্লাসের চিত্রবিচিত্র উপকরণ নিয়ে আসে ঈদুল ফিতর। ঈদের আনন্দের মাঝেও তিনি মুসলমানদের গৌরবদীপ্ত অতীতের কথা বিস্মৃত হননি। ঘুমন্ত পশ্চাৎপদ মুসলমানের মনে উজ্জীবনের জোয়ার জাগাতে নজরুল দুরন্ত দুর্বার। তাই শোনা
যায় প্রেরণাসঞ্চারী উজ্জীবনের নিরন্তর আবাহন,
“পড়বি ঈদের নামাজরে মন এই সেই ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ। “
সাম্য -মৈত্রীর অতন্দ্র বংশীবাদক নজরুল এ সংগীতে হিংসা, সংকীর্ণতা অসাম্য ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক মনোবৃত্তির শেকড় ছিঁড়ে মানবতার সোনালি রাজপথে আবাহন জানিয়েছেন। এর উদাত্ত আবাহন সংগীতে এনেছে হৃদয়রঞ্জক প্রদীপ্তি। তিনি বলেন,
” তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ “।
নজরুলের সৃজনাকাশজুড়ে যে আলো র অবিনাশী বিচ্ছুরণ তাহলো, মানব প্রেম। মানবিকতা তাঁর কাব্যে অন্ত:সলিলা ফল্গুধারারমতো নিরন্তর বহমান।অন্যান্য রচনার সাথে সাম্যবাদী কবিতায় মানুষের কবি নজরুলের দরদি হৃদয়ের অপূর্ব সৌন্দর্য মাধুর্য তথা দীপ্তি সমুদ্ভাসিত। এখানেও কবি সেই ভাব -রাগে অনুরঞ্জিত । তাঁর হৃদয় ভুখা, এতিম মিসকিন তথা নিঃস্ব মানবতার স্মরণে অধীর আকুল। এ কারণেই সংগীতের সুরেলা মূর্ছনায় দেখা যায় মানবিকতার আশ্চর্য সুন্দর প্রতিচ্ছবি। মানব কল্যাণে কবি সর্বক্ষেত্রেই সোচ্চার। এখানেও শোনা যায় কবির উচ্চকণ্ঠ,
” যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা নিত উপবাসী।
সেই গরীব মিসকিন এতিমে দে, যা কিছু মফিদ। ”
এ আবাহন অনিন্দ্যসুন্দর।
এভাবেই ঈদুল ফিতরের এই কালজয়ী গানে নজরুল ভাস্মর হয়ে আছেন স্বমহিমায়, স্বগৌরবে।
বস্তুত, ভাবের হিন্দোল, বর্ণনার দীপ্তি, অন্তমিলের ব্যঞ্জনা, সুরের মধুরিমা, অলংকারের ঝলক, নিবিড় মনস্বিতা ইত্যাদি ইত্যাদি মণি -কাঞ্চনযোগে এ গানের উপযোগিতা কালের আকাশে প্রদীপ্ত ধ্রুবতারা হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র:
১. করুণাময় গোস্বামী, বাংলা সংস্কৃতির শতবর্ষ, সংগীত (প্রবন্ধ), নারায়ণগঞ্জ, পৃ ২০৭-২০৮।
২. শাহিনুর রেজা, চক্রবাক, নজরুলের ঈদের গান (প্রবন্ধ), ঢাকা, পৃ ৫৭-৫৮।
৩. আব্দুল আজিজ আল আমান,নজরুলগীতি অখণ্ড, কলকাতা, পৃ ২১৪ থেকে সংগীতের অংশবিশেষ চয়িত।
লেখক: জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]