মানুষ যখন ডুবে যেতে থাকে, তখন তাকে টেনে তুলতে হয়। ফিলিস্তিন মূলত ডুবে যাচ্ছে। সাঁতরানোর মতো অবস্থা তাদের নেই। গাজার জনগোষ্ঠীর শেষ অস্তিত্বটুকু ধীরে ধীরে মুছে ফেলা হচ্ছে। গাজা উপত্যকার প্রান্তে প্রান্তে এখন স্বজন হারানোর মাতম। কেবল আওয়াজ বা প্রতিশ্রুতিতে কাজ হয় না। শুধু মুখের বুলি যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘের প্রস্তাব, আনুষ্ঠানিক নিন্দা, সাগরের মাঝে এক ফোঁটা পানি পরিমাণ ত্রাণ পাঠানো যথেষ্ট কী? আজ যদি আরব বিশ্ব নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ ত্যাগ করে নৈতিক অবস্থান থেকে কথা না বলে, তাহলে আর বলবে কে?
‘দুনিয়া ঘনিয়ে আসছে আমাদের দিকে/ ধরিত্রী ঠেসে ধরছে একেবারে শেষ কোনাটায়…/ শেষ প্রান্তে ঠেকে গেলে যাবটা কোথায়?/ শেষ আসমানে ঠেকে গেলে পাখিগুলো ডানা ঝাপটে উড়বে কোথায়?/ হয়ার শুড দ্য বার্ডস ফ্লাই আফটার দ্য লাস্ট স্কাই?’
মাতৃভূমি রক্ষায় ফিলিস্তিনের করুণ, হৃদয়গ্রাহী ও ক্রমেই কোণঠাসা হতে থাকা জীবনের অসহায়ত্ব নিয়ে লেখা এই কথাগুলো ফিলিস্তিনের নির্বাসিত জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের ‘দ্য আর্থ ইজ ক্লোজিং অন আস’ থেকে নেওয়া। কবিতাটির ‘আফটার দ্য লাস্ট স্কাই’ বা ‘শেষ আসমানের পর’ কথাটি নিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদ লিখেছিলেন ফিলিস্তিনি জীবনবিষয়ক বই আফটার দ্য লাস্ট স্কাই। সেখানে সাঈদ বলেছেন, ‘শেষ আসমানের পর আর কোনো আসমান নেই। শেষ ভূখণ্ডের পর আর কোনো ভূখণ্ড নেই। তাই ফিলিস্তিনিদের আমৃত্যু লড়াই ছাড়া আর কোনো পথও খোলা নেই।’
ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের হামলার পর থেকে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় শুধু প্রথম ৬ দিনেই ৪ হাজার টন ওজনের প্রায় ৬ হাজার বোমা ফেলার কথা জানিয়েছে খোঁদ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এছাড়া তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানিয়েছে গত ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ৩২ হাজার টন বোমা ফেলেছে ইসরায়েল। এসব বোমার আঘাতে গাজায় সাড়ে ১১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশু।
অবরুদ্ধ গাজায় খাবার, ওষুধ, পানি কোনো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। ত্রাণ থেকে যে খাবার ও সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে, তা খুবই অপ্রতুল। ফিলিস্তিনের হাসপাতালে থাকা রোগীরা প্রতিদিন পানি পাচ্ছেন ৩০০ মিলিলিটার। একজন সাধারণ মানুষের প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি পান করা দরকার, তার ৭ ভাগের এক ভাগের কম পানি পাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। সেখানে বোমার মতোই খাদ্যসংকট চরমে।
গাজা ও অধিকৃত জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে চলছে ইসরাইলী সেনাবাহিনীর বিরামহীন গণহত্যা, ধ্বংস-প্রক্রিয়া ও গণনির্মূল প্রকল্প। গাজার হাসপাতাল, উদ্বাস্তু শিবির, আবাসিক ভবন, মসজিদ সে বোমা বর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। গাজার সর্ববৃহৎ উদ্বাস্তু শিবির জাবালিয়া’র উপর ইসরাইল বিমান বাহিনী ২ বার বোমা বর্ষণ করেছে। ইসরাইল দানবের মতো এমন জায়গাগুলো নিশানা করছে, যেখানে দিশেহারা ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় নিয়েছেন। তারা খাবার, পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি সব বন্ধ করে দিয়েছে। যা মানবতাবিরোধী অপরাধ। এমন ঘটনা বিশ্বের কোথাও কখনো ঘটেনি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও নয়।
ইসরাইলের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে, এখন সন্ত্রাসই ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় নীতি। অবৈধ এ দেশটি বেঁচেও আছে আদিবাসী ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চালিয়ে। এখন সন্ত্রাসের মধ্য দিয়েই ইসরাইল তার বৃহত্তর ইসরাইলের মানচিত্রের প্রতিষ্ঠা চায়। দেশটি বেঁচেও আছে সম্পূর্ণ অবৈধ পথে। জš§ থেকেই ইসরাইলের ইতিহাস হলো অধিকৃত ভূমিতে বিরামহীন দখলদারি, জুলুম, নির্যাতন ও হত্যা। একদিকে তারা যেমন মূলভূমিকে দখলে নিয়ে সে ভূমির আদিবাসীদের বিতাড়িত করেছে, তেমনি সে ভূমিতে গড়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে আগত ইহুদীদের জন্য কলোনী।
ফিলিস্তিনে হামাসের স্বাধীনতার লড়াই নয়, এটা পিতৃভুমি রক্ষার লড়াই। স্বাধীনতার জন্য লড়া আর পিতৃভুমি রক্ষার জন্য লড়া এক কথা নয়। আশ্রিত কেউ বাড়ি দখল করে বাড়ির মালিককেই বিতারিত করাকে কীভাবে সমর্থন করা যায়? ঘটনা কেবল গত ৭ অক্টোবর রকেট হামলার পর শুরু হয় নি। প্রায় ৭৫ বছর ধরে জায়নবাদীদের বেআইনি আচরণ এবং জোর করে হত্যা নির্যাতন চালিয়ে ফিলিস্তিন ভূমি দখল করাটাই এসবের মূল কারণ।
ইহুদীদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে জায়নবাদ (জায়োনিজম) নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। হিব্রু ‘জায়ন’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। জায়ন হচ্ছে জেরুসালেমের একটি পাহাড়ের নাম, এর অর্থ হচ্ছে দাগ কাটার মতো ঘটনা বা স্মৃতি উৎসব। আধুনিক জায়নবাদের জনক থিওডর হার্জল। হার্জল ছিলেন একজন সাংবাদিক, লেখক এবং রাজিনীতিবিদ। ইহুদিবাদি সংস্থার মাধ্যমে তিনি এবং তার সহযোগীরা নিজেদের ভাবাদর্শের প্রচার করতেন এবং ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচার চালাতেন।
এছাড়া জায়োনিজম ও জুদাইজম এক নয়। জায়োনিজম হলো ইহুদি ধর্মের অনুসারীদের একটি বিশেষ গোষ্ঠী যারা রাজনৈতিকভাবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে ও অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে মরিয়া হয়ে আছে। আর অন্যদিকে জুদাইজম হলো ইহুদি ধর্মের ধর্মীয়, শান্তিপ্রিয় মতবাদ। যারা জায়োনিজমকে ধারণ করে তারা সকলেই ইহুদি কিন্তু সকল ইহুদি জায়োনিজম সমর্থন করে না। জায়োজিমকে বা জায়নবাদকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। স্বয়ং ইহুদিরাই, যারা জায়োনিস্ট নন, তারাই স্পষ্ট করে বলছে যে, জায়োনিজম হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। পৃথিবীতে অন্যতম বর্ণবাদি হলো জায়োনিস্টরা। এই জায়নিস্ট চক্র অনবরত ফিলিস্তিনিদের জায়গাজমি দখল করে তাতে সরকারি অনুদানে আবাসিক এলাকা বানিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে বা অভ্যন্তর থেকেই ইহুদি হলেই তাকে ওই বাড়ি বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী অন্য ধর্মাবলম্বী লালস, ধনলোভী, অর্থলোভীদের প্রলুব্ধ করার উদ্দেশ্যে তারা নারী, অর্থ বিত্তসহ প্রলুব্ধ করার যাবতীয় উপাদানকে ব্যবহার করে।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয়। হামাসের কিছুই করার নেই। যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন ডু অর ডাই ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। দীর্ঘদিন জেলে আটকা জনগণ মুক্তির জন্য বেপরোয়া হবে এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করবে, সেটিই তো স্বাভাবিক। আজ হামাস যা কিছু করছে, তা-ই অতি প্রত্যাশিত। পশ্চিম তীরের প্রায় পুরোটাই ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দখলে চলে গেছে। ইতিপূর্বে নেতানিয়াহু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে বলে এসেছেন, ইসরায়েলের নেতৃত্বে তিনি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র তৈরি করবেন। তার সেই মানচিত্রে তিনি গাজার অস্তিত্ব রাখেননি। ইসরায়েল বলছে, গাজাকে গিলে ফেলবে। তারা গেলা শুরু করেও দিয়েছে। আর বরাবরের মতো চুপ করে আছে বিশ্ববিবেক। পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তিনিরা এখন কী করবে?
যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিদের জমিতে অবৈধ দখলদার ইসরায়েল। একটু একটু করে ফিলিস্তিনের প্রায় গোটা মানচিত্রই গিলে ফেলছে দেশটি। একটি সার্বভৌম ভূখ-ের ওপর এমন দখলদারি ও আগ্রাসন বিশ্ববাসী শুরু থেকেই মেনে নেয়নি। ফলে ফিলিস্তিনের কোথাও ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় বিশ্বের নানা জায়গা থেকে প্রতিবাদের আওয়াজ ওঠে।
ইতিপূর্বে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ইসরায়েলকে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার নৌ সেনাসহ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে আধুনিক রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড পূর্ব ভূমধ্যসাগরে পাঠিয়েছে। মার্কিন বিমানবাহী রণতরি এখন ফিলিস্তিনের উপকূলে। জেরাল্ড ও ফোর্ডের সঙ্গে একটি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ এবং চারটি ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসকারী জাহাজ রয়েছে। অস্টিন বলেছেন, এই বহরের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষিপ্রগতির এফ-৩৫ বিমানের পাশাপাশি এফ-১৫, এফ-১৬ এবং এফ-১০ ফাইটার জেট পুরো এলাকা ঘিরে রাখার জন্য যুক্ত থাকবে।
নিয়মিত অত্যাচারী আর ভূমি দখলকারী ইসরাইলকেই আমেরিকা সমর্থন দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের জš§ ও জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ প্রাপ্তিসহ সব কিছুতে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়া হয়েছিল প্রধানত আমেরিকার কারণে। সেই থেকে যে অন্যের ঘরবাড়ি লুট ও হত্যাকারী, তারই আবার ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ এই নির্লজ্জ কথার ওপর দাঁড়িয়ে আমেরিকা ইসরাইলের পক্ষে সাফাই জোগাড় করে গেছে ও যাচ্ছে। মুসলিম দেশ আক্রান্ত হলে মানবতার স্লোগানধারী পশ্চিমা অনেক দেশ নিশ্চুপ থাকে। ইউক্রেনিরা মারলে সেল্ফ ডিফেন্স আর ফিলিস্তিন মারলে সন্ত্রাসী!
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দির ইউরোপ ও আমেরিকায় ইহুদীরা অত্যন্ত ঘৃণার পাত্র ছিল। একটি অভিশপ্ত জাতি হিসেবে ইহুদীরা খৃস্টানদের কাছেও নিন্দিত ছিল। ওই সময় এ দুটি মহাদেশের বাসিন্দাদের অনেকের বাড়িতেই একটি সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যেতো যাতে লেখা থাকতো ‘ডগস এন্ড জিউস (ইহুদি) আর নট এলাউস’, অর্থাৎ, কুকুর এবং ইহুদির প্রবেশ নিষিদ্ধ। খৃস্টান জগত সর্বসম্মতভাবে এই বিশ্বাস পোষণ করতো যে ইহুদীরা হচ্ছে ‘ডিসাইড ন্যাশন’, অর্থ্যাৎ, আল্লাহর নবীদের হত্যাকারী একটি জাতি। এ প্রেক্ষিতে ইহুদীদের প্রতি লানত বর্ষণ করা খৃস্টানদের উপাসনার একটি অপরিহার্য অংশ ছিল।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইসলাম, ইসলামের সভ্যতা সংস্কৃতি, আচার আচরণ ধ্বংস ও মুসলিমদের সন্তানদের নাস্তিক্যবাদী আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য তারাই অর্থ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে। চীন, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, চিলি এমনকি আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও জায়নবাদীরা নিয়ন্ত্রণ করে তাকে। জার্মানীকে ইহুদী মুক্ত করার জন্যই হিটলার গণহত্যার আশ্রয় নিয়ে ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করেছিলেন। হিটলার একথাও বলেছিলেন, আমি ইচ্ছা করলে সব ইহুদি মেরে ফেলতে পারতাম, কিন্তু কিছু ইহুদি রেখে গেলাম এ জন্য যে, পরবর্তী প্রজš§ বুঝতে পারে আমি কেনো ইহুদিদের মেরেছি। এরপরের ইতিহাস সবারই জানা, হিটলারের উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হলোকাস্টে ইহুদিদের উপর চালানো ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। গ্যাসচেম্বারে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারাসহ সব নৃশংসতা, গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করাসহ সব।
জানা যায়, এডলফ হিটলারের পরাজয়ের পর আত্মগোপনে থাকা হিটলারের প্রধান সেনাপতি ইহুদিদের হাতে ধরা পরলে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছে কী? উত্তরে সে বলেছিলো, মৃত্যুর পূর্বে আমার শেষ ইচ্ছে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করা। সারা জীবন ইহুদি বিদ্বেষী থেকে, ইহুদিদের নির্বিচারে হত্যা করেও কেন মৃত্যুর পূর্বে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক জানতে চাইলে হিটলারের প্রধান সেনাপতি বলেন, আমাকে হত্যার মাধ্যমে আমি আমার মৃত্যুর পূর্বে শেষবারের মতো জেনে যেতে চাই, পৃথিবী থেকে আরো একজন ইহুদিকে হত্যা করা হচ্ছে!