ইউনূসের পক্ষে ৪০ বিশ্বনেতার খোলা চিঠি: শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা!

::
প্রকাশ: ২ years ago
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি

নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের নাম আবারও মিডিয়ার নতুন করে আলোচিত হচ্ছে। সম্প্রতি ৪০ জন বৈশ্বিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দাবি করেছেন যে অধ্যাপক ইউনূস সরকারের “অন্যায় আচরণের” শিকার। এতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, দেশটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, প্রয়াত মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডির ছেলে টেড কেনেডি জুনিয়রের মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব৷ গত মঙ্গলবার (৭ মার্চ, ২০২৩) ওয়াশিংটন পোস্টে একটি পূর্ণ-পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন হিসাবে প্রচারিত চিঠিতে তারা ড. ইউনূসের প্রতি ‘হয়রানি’ বন্ধ করতে ও তার পরিচালিত সংস্থাগুলির উপর সরকারী তদন্ত বন্ধ করতে সরকারকে আহবান করেন।
চিঠিটিকে মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, চিঠির অভিযোগগুলো উদ্দেশ্যমূলক, পক্ষপাতদুষ্ট এবং অনুমানের উপর ভিত্তি করে লেখা৷ চিঠিতে দাবি করা হয়েছে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশ সরকারের অযৌক্তিক আক্রমণ ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। তবে ডাঃ ইউনূস কী ধরনের অন্যায় বা আক্রমণের মুখোমুখি হ্চ্ছেন বা তার কোন কোন কাজে বাধা পাচ্ছেন তা তারা নির্দিষ্ট করেননি। তিনি বাংলাদেশে হয়রানির শিকার হচ্ছেন এমন কোনো খবর স্থানীয় বা বিদেশী সংবাদমাধ্যমও নেই। তিনি বিদেশে অগণিত স্থানে ভ্রমণ করেছেন; তাকে কি বাধা দেয়া হচ্ছে? তার বিদেশ ভ্রমণ কি নিষিদ্ধ করা হয়েছে? নোবেল বিজয়ীকে কীভাবে হয়রানি করা হচ্ছে তার কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। তাই, এই অভিযোগটির কোন ভিত্তিই নেই। সরকার ইউনূসের সাথে এমন আচরণ করেনি যাতে একটি খোলা চিঠি বিজ্ঞাপন আকারে চাপাতে হবে। তাই বিশ্লেষকরা এটিকে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে একটি ”কলঙ্কজনক প্রচারণা” বলে অভিহিত করেছেন।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

মজার ব্যাপার হচ্ছে, খোলা চিঠিটি এমন এক সময়ে লেখা হয়েছে যখন তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আর্থিক অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগের জন্য তদন্ত ও বিচার শুরু হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে ২ মিলিয়ন ডলার অবৈধ অর্থ অর্জন, ৪.৮ মিলিয়ন ডলারের অপব্যবহার এবং ৩১৪ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ বিভিন্ন তদন্তে ইউনূসের অধীনে গ্রামীণ ব্যাংকে অন্যান্য জালিয়াতি, অসঙ্গতি এবং বেআইনি কার্যকলাপ উন্মোচিত হচ্ছে। মুহম্মদ ইউনূসের ১৪টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার আয়কর ফাকি দিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। মোটকথা, ডক্টর ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থপাচারে ও কর সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব ব্যুরো (এনবিআর) সহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছে। এখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা কী?
এছাড়াও, ডক্টর ইউনূস তার নিজস্ব স্বার্থে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় বিদেশী দাতাদের তহবিল অবৈধভাবে স্থানান্তর করেছিলেন এবং গ্রামীণ টেলিকম ইউনিয়নের শ্রমিক-কর্মচারীদের ২৫০ মিলিয়ন টাকা দিয়ে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা ১১০টি মামলা বেআইনিভাবে নিষ্পত্তি করেছেন বলেও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়গুলো নি:সন্দেহে ড. ইউনূসকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশ সরকার এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বব্যাপী লবিং শুরু করেছেন। এটি স্পষ্ট যে, নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি বিশ্বনেতাদের সাথে তার সম্পর্ককে রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন।
চিঠিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা সংবাদপত্র ”ওয়াশিংটন পোস্টে” বিজ্ঞাপন হিসেবে ছাপা হয়েছিল, কোনো সংবাদ নয়। বিজ্ঞাপন প্রকাশে পত্রিকাটির নীতিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে চিঠিটি তাদের নিজস্ব মতামতের প্রতিফলন নয়। এটি একটি পেইড কনটেন্ট। চিঠিটি সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানোর পরিবর্তে আনুমানিক ৭৩ হাজার ৩৩৩ ডলার (৭৮ লাখ ১৪ হাজার ৫৮৪ টাকা) খরচ করে ওয়াশিংটন পোস্টে পুরো পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন হিসাবে প্রকাশ করা হয়। এত লক্ষ টাকা খরচ করে কেন তা প্রচার করতে হলো? এই চিঠি প্রকাশে এত লক্ষ টাকা কে খরচ করল সেটি সহজেই অনুমেয়। নিশ্চয়ই হিলারি ক্লিনটন, আল গোর বা বান কি মুনের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অর্থ দেননি। তাছাড়া, কেন এই চিঠি অন্যান্য আন্তর্জাতিক নেতাদের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় না?
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ড. ইউনূস গ্রামীণ ফোন থেকে লাভবান হননি। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, গ্রামীণ ফোনের গ্রাহক সংখ্যা ২৮ মিলিয়ন, বার্ষিক আয় ১ বিলিয়নের ডলারেরও বেশি, এবং লাভ কয়েকশ মিলিয়ন ডলার, এটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বৃহত্তম টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী সংস্থা। তাহলে দেশের নাগরিকদের টাকা গেল কোথায়? কেন তিনি মুনাফা না নিয়ে নরওয়ে সরকারের মালিকানাধীন টেলিনর কোম্পানির কাছে গ্রামীণফোনের শেয়ার বিক্রি করে দিলেন? এটির উদ্দেশ্য কী? নোবেল পুরষ্কার যারা পায় তাদের পেছনে নরওয়েজিয়ান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখার বিষয়টি ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে আলোচিত। তাহলে কি গ্রামীণফোনের মতো একটি সমৃদ্ধশালী কোম্পানিকে মুনাফা না করে ছেড়ে দিয়ে তিনি নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন!
এটা দুঃখজনক যে, আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ তাদের বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য প্রকৃত ঘটনা না জেনেই মাঝে মাঝে বাংলাদেশী প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে। পূর্বোক্ত অপরাধগুলোর দিকে নজর না দেওয়ার কারণে হিলারি ক্লিনটন এবং তার স্বামী বিল ক্লিনটন নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে আছেন। তিনি দক্ষতার সাথে তার জালিয়াতি এবং দুর্নীতির ঘটনাসমূহ হিলারী ক্লিনটন সহ বিদেশের অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের থেকে গোপন, সেইসাথে বিশ্ব মিডিয়া থেকেও মনোযোগ সরিয়ে নিতে সফল হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে ইউনূস-নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলি অতীতে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে ১২৫,০০০ ডলার থেকে ৩০০,০০০ ডলার দিয়েছেন। আমরা কখনই নির্ধারণ করতে পারব না, প্রফেসর ইউনূস ক্লিনটন থেকে যে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন তার বিনিময়ে তাকে কত টাকা দিয়েছেন। সারা বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা কি মুহাম্মদ ইউনূসের এসব প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে পারেন না!
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত আছে এমন প্রতিটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজের আইনে বলা আছে, ‘কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়’, সে যতই শক্তিশালী এবং বড় হোক না কেন। আমরা জানি যে পশ্চিমা দেশগুলোর বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিখ্যাত কর্মকর্তারা এমনকি সেসব দেশের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীও যদি কর ফাঁকি দেন বা দুর্নীতি করেন, সে দেশের আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অনেকেরই জেল ও জরিমানার রেকর্ড রয়েছে। অথচ, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানির মতো বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে ড. ইউনুস বাংলাদেশের আইন-কানুন নিয়ে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বাংলাদেশের জনগণ হতবাক হয়েছে যে তার মতো একজন সম্মানীয় লোক ব্যক্তিগত লাভের জন্য কিভাবে দেশের সুনাম নষ্ট করতে পারেন!
অনিয়ম ও দুর্নীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কয়েকজন বিশ্ব নেতারা এমন একজন ব্যক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন যিনি তার ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য নোবেল পুরস্কারের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা সহ সবকিছু করতে পারেন। বাংলাদেশিরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে পশ্চিমা নেতারা মুখোশের পিছনে অধ্যাপক ইউনূসের কুৎসিত চেহারা চিনতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই জনগন আশা করে, যারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন তারা অন্তত অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখবেন।

লেখক: মাশরুর সিদ্দিকি, গবেষক এবং কলামিস্ট।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net