চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের ফেসবুক পেজে নানা মন্তব্য করা হয়েছিল। তবে মন্তব্য করা এসব ফেসবুক অ্যকাউন্টগুলো মানুষ পরিচালিত নয়, বরং ভুয়া বা ফেক ওই প্রোফাইলগুলো পরিচালিত হয়েছে বট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন এক হাজার ৩৬৯টি ফেসবুক প্রোফাইলের একটি বট নেটওয়ার্কের সন্ধান মিলেছে। বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) গবেষণাটি প্রকাশ করেছে ডিসমিসল্যাব।
গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুকে এসব প্রোফাইল থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ১৯৭টি পোস্টে সমন্বিতভাবে ২১ হাজারের বেশি মন্তব্য করা হয়েছে। বিভিন্ন পোস্টে নানা প্রোফাইল থেকে একই মন্তব্য করতে দেখা গেছে। তবে বট অ্যাকাউন্ট ও এর করা মন্তব্যের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মূলত বট নেটওয়ার্ক একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যেখানে বিশেষ সফটওয়্যারের (বট) মাধ্যমে কাজ করা হয়। এর কার্যক্রম আংশিকভাবে কম্পিউটারভিত্তিক বা স্বয়ংক্রিয়। এই প্রক্রিয়ায় একটি তালিকা থেকে নির্দিষ্ট ‘কি-ওয়ার্ড’ বা শব্দ ধরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পোস্ট বাছাই করা হয়। আর অপর একটি তালিকা থেকে বেছে নিয়ে মন্তব্য পোস্ট করে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কোথায় কী মন্তব্য পোস্ট করা হচ্ছে, সেখানে মানুষের নজরদারি নেই বললেই চলে।
গবেষণায় দেখা যায়, গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে বট নেটওয়ার্কটি সক্রিয় হয়। গত জুন পর্যন্ত বট নেটওয়ার্কটি ঘুরেফিরে ৪৭৪টি একই ধরনের রাজনৈতিক মন্তব্য করেছে। মন্তব্যগুলো নির্বাচনের আগে তৈরি করা হলেও বট নেটওয়ার্কটি নির্বাচনের পরেও সেই একই মন্তব্য পোস্ট করেছে। বট নেটওয়ার্কটি লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে দেশের প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম ও তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেসবুক পেজকে।
ওই গবেষণায় ভুয়া প্রোফাইলগুলোর মধ্যে একধরনের সংযোগ থাকার চিত্রও পাওয়া গেছে। মূলত দুটি নির্দিষ্ট পেজে লাইক দেয়ার প্রবণতা থেকে এই চিত্র সামনে আসে। এসব অ্যাকাউন্টের মধ্যে প্রোফাইল ‘লকড’ নেই, এমন এক হাজার ১২৪টি অ্যাকাউন্টের ৭০ শতাংশই বাংলার খবর’ এবং ‘আওয়ামী লীগ মিডিয়া সেল’ নামের পেজ দুটির কোনো একটিকে বা দুটিকেই অনুসরণ (ফলো) করেছে। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগ মিডিয়া সেল পেজটি আর পাওয়া যাচ্ছে না।
যেভাবে খোঁজ মিলল বট নেটওয়ার্কের
গত ২১ জুন ‘কালার প্রিন্টারে ছাপানো প্রতিটি পৃষ্ঠায় থাকে অদৃশ্য কোড?’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয় দেশের একটি অনলাইন গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে। নিউজটি তাদের ফেসবুক পেজেও শেয়ার করা হয়। উভয় ক্ষেত্রে পোস্টের নিচে একটি মন্তব্য দেখা যায়। সেটি হলো, ‘এবারের নির্বাচন স্বচ্ছ হবে। আগামী নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। আর এবার ভোট চুরি করতে পারবে না বলেই বিএনপি নির্বাচনে আসতে ভয় পাচ্ছে আর এত কাহিনি করছে’।
নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস পরে এসেও ‘ব্যবহারকারীরা’ এই পোস্টের নিচে বিএনপির সমালোচনা, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফল ও সুষ্ঠুভাবে হওয়ার আশাবাদ, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবিসহ নানা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে একের পর এক মন্তব্য করে। এমন মন্তব্যের কারণ খুঁজতে গিয়েই এক হাজার ৩৬৯টি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একটি বট নেটওয়ার্কের সন্ধান পায় ডিসমিসল্যাব।
গবেষণার জন্য গণমাধ্যমটির ওই ফেসবুক পোস্ট থেকে প্রতিটি মন্তব্য সংগ্রহ করে ডিসমিসল্যাব। সেই তালিকা ধরে গুগলে সার্চ দিয়ে একই মন্তব্য রয়েছে, এমন আরও ১৯৬টি পোস্ট বের করা হয়। সেসব পোস্ট থেকে আবার প্রতিটি মন্তব্য নিয়ে ৩৫ হাজার মন্তব্যের একটি ডেটাবেজ তৈরি করা হয়। এই ডেটাবেস থেকে বট অ্যাকাউন্ট ও এর করা ২১ হাজারের বেশি রাজনৈতিক মন্তব্য আলাদা করা হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, বট নেটওয়ার্কটি সাধারণত রাজনৈতিক পোস্টেই মন্তব্য করেছে। ফেসবুক পোস্টে নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক ‘কি-ওয়ার্ড’ বা শব্দ পেলে তারা সেই পোস্টে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু কখনো কখনো তাদের ভুল হয়। যেমনটি হয়েছে ‘ইসি’ (নির্বাচন কমিশন) শব্দের ক্ষেত্রে। কালার প্রিন্টার-সংক্রান্ত খবরটির সারাংশে ‘মেশিন আইডেনটিফিকেশন কোড (এমআইসি) ’-এর উল্লেখ ছিল। সেখানে ‘ইসি’ শব্দাংশ দেখেই বট নেটওয়ার্কটি শ খানেক মন্তব্য করে।
গবেষণার জন্য বাছাই করা ‘বট’ প্রোফাইলগুলোর মধ্যে ২৪৭টি ‘লকড’ অবস্থায় ছিল। বাকি ১ হাজার ১২২টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে ৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে প্রোফাইল ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা। ছবিগুলো অন্যের। কোথাও কোথাও একই ছবি বিভিন্ন প্রোফাইলে ব্যবহার করা হয়েছে।
এছাড়া এসব প্রোফাইলের ৭৭ শতাংশ নারীদের নামে। এসব নামেও রয়েছে অদ্ভুত মিল। নারীদের প্রোফাইলের ২৪ শতাংশের নাম ‘আক্তার’ দিয়ে শেষ হয়েছে। যেমন দিয়া আক্তার, রিয়া আক্তার, লিজা আক্তার, লিমা আক্তার, লিসা আক্তার ইত্যাদি। আর পুরুষদের প্রোফাইলগুলোর একটি বড় অংশের শেষ নাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘আহমেদ’। যেমন নাঈম আহমেদ, নাদিম আহমেদ, কামিল আহমেদ, মাহিন আহমেদ, সামির আহমেদ ইত্যাদি। নারী-পুরুষ উভয় ধরনের প্রোফাইলের ৯০ শতাংশ নামই দুই শব্দের। কিছু ক্ষেত্রে একটি নামকেই ভেঙে দুই শব্দ করা হয়েছে। যেমন রি পা, মি না, লি জা, যু থি, লাম ইয়া, মু না, নে হা, জোস না ইত্যাদি।
গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ফেক প্রোফাইলগুলো সক্রিয় হয়েছে মূলত গত বছরের জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে। ফেক প্রোফাইলগুলোর অর্ধেকই সক্রিয় হয়ে ওঠে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে। শুধু নভেম্বরের ২৩ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে প্রথমবারের মতো পোস্ট করে ৩৪৪টি অ্যাকাউন্ট। এর আগে ২ থেকে ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৪০টি প্রোফাইল সক্রিয় হয়। আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এ বছরের ৭ জানুয়ারি।
গবেষণায় পাওয়া রাজনৈতিক ২১ হাজার ২২১টি মন্তব্যের মধ্যে ইউনিক ছিল মাত্র ৪৭৪টি। বটগুলো বিভিন্ন পোস্টে ঘুরে ফিরে এই ৪৭৪টি মন্তব্যই করেছে। বটগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। যেমন রিয়া আক্তার নামের একটি প্রোফাইল থেকে গত ছয় মাসে বিভিন্ন পোস্টে ১৩৮টি মন্তব্য করা হয়েছে। নির্বাচনের অনেক পরে ১৮ মে এই প্রোফাইল থেকে একটি মন্তব্য করা হয়।
বিভিন্ন সময় মোট ৯৬টি পোস্টে একই মন্তব্য করা হয়েছে দিয়া আক্তার, রাইসা, রাফিয়া আক্তার, নাহিদ, নিপাসহ মোট ১০৯টি বট প্রোফাইল থেকে। বট নেটওয়ার্কটি মূলত ৪২টি ফেসবুক পেজকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। যেগুলো মূলত বিভিন্ন গণমাধ্যম ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের। এর মধ্যে ৬৮ শতাংশ পেজ প্রথম সারির ও পরিচিত গণমাধ্যমের। এককভাবে ৩১ শতাংশ পেজ হলো বিএনপির বা বিএনপি-সংশ্লিষ্ট। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণসংহতি আন্দোলনের পেজকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়।
বট মন্তব্যগুলোর ৮৬ শতাংশেই বিএনপি ও দলটির নেতা-নেত্রীদের সমালোচনা বা তাদের প্রতি আক্রমণ করা হয়েছে। যেমন-‘আগুন-সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপি। এদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি’ বা ‘আত্মসাৎ, অর্থপাচার করে বাংলাদেশকে লুটপাট করার হাওয়া ভবন করার চক্রান্ত করছে বিএনপি’। বাকি ১৪ শতাংশ মন্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা এবং নির্বাচন শান্তিপূর্ণ বা সুষ্ঠু করার আহ্বান।
গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হলেও ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে বা জুন মাসেও বট প্রোফাইলগুলো থেকে ‘আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন’, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে’ জাতীয় কথা ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, মন্তব্যগুলো নির্বাচনের আগে তৈরি করা। কিন্তু তা নির্বাচনের পরও নির্বিচার পোস্ট করা হয়েছে।
বট প্রোফাইল থেকে অপ্রাসঙ্গিক পোস্টেও রাজনৈতিক মন্তব্য করা হয়েছে। এসব পোস্টের প্রতিটির বিবরণেই কোনো না কোনোভাবে ‘ইসি’ শব্দটি আছে। যেমন আইসিইউ, আইসিসি, রইসি, আইএফআইসি, ওআইসি, আইসিটি, ডায়ালাইসিস বা ক্রাইসিস। বট নেটওয়ার্কটি তার লক্ষ্যবস্তু পেজে যেখানেই ‘ইসি’ শব্দাংশ পেয়েছে, সেটি প্রাসঙ্গিক হোক আর না হোক, সেখানেই সমন্বিতভাবে রাজনৈতিক মন্তব্য করেছে। গবেষণায় বলা হয়, এটি ইঙ্গিত করে যে নেটওয়ার্কটি কোন পোস্টে মন্তব্য করবে, সেটি বাছাইয়ের জন্য কি-ওয়ার্ড-নির্ভর একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের গবেষণা দেখাচ্ছে, বট নেটওয়ার্কের বিস্তার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নির্ভুল তথ্যব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের নেটওয়ার্ক অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গিকে দমন করতে পারে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রচার করার মাধ্যমে জনসাধারণের আলোচনাকে বিকৃত করতে পারে। এই কারসাজি জনমতের মেরুকরণ করতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা নষ্ট করতে পারে।
বট নেটওয়ার্কটি কম্পিউটারভিত্তিক অপপ্রচারের একটি উদাহরণ বলে মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ফিলিপ মেরিল কলেজ অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইনফরমেশন স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক নাঈমুল হাসান। তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ ও কম্পিউটারভিত্তিক টুলের সাহায্যে সংঘবদ্ধভাবে মূলত এসব কাজ করা হচ্ছে।
নাঈমুল হাসান আরও বলেন, ভবিষ্যতে প্রযুক্তিগুলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে আরও উন্নত হবে। ফলে একই প্রোফাইল ছবি বিভিন্ন ভুয়া অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়বে না। এআই দিয়ে নিমেষেই অনেকগুলো প্রোফাইল ছবি তৈরি হয়ে যাবে, যাতে সংঘবদ্ধ অপপ্রচারমূলক আক্রমণগুলো চিহ্নিত করা কঠিন হয়। তাই এখন থেকেই বিষয়গুলো নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।