আ. লীগের আমলে গুমে জড়িতদের টাকার হিসাব রাখার জন্য আছে ম্যানেজারও

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন রিপোর্ট | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ১ সপ্তাহ আগে
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কিছুদিন পরেই আলোচনায় আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন। গুম ক্রসফায়ার থেকে শুরু করে তার বিরুদ্ধে গুরুতর সব অপকর্মের অভিযোগ উঠতে শুরু করে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় গ্রেপ্তার বাণিজ্য, চাঁদা তোলাসহ সন্ত্রাসীদের সুযোগ-সুবিধা দিতেন তিনি।

পুলিশের চাকরিতে ঢোকার কিছুদিনের মধ্যে সরকারের কাছের মানুষ ওঠেন আলেপ উদ্দিন। চাকরির এক বছর পরই তাকে র‌্যাবে পাঠানো হয়। র‌্যাব-১১-তে দায়িত্ব পালনকালে তিনি গুম ও ক্রসফায়ার করে হাত পাকান। জানা গেছে, র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা ইউনিটে গিয়ে এই কর্মে অভিজ্ঞতা বাড়ান। আর তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ মিলিয়ে অন্তত ২০টি গুমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। সূত্র মতে, রাজধানীতেই আলেপের নেতৃত্বে ১০-১২ জনকে গুম করা হয়।

কুড়িগ্রামের সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া আলেপ পুলিশে চাকরি পাওয়ার পরপরই বদলে যেতে থাকেন। অল্প সময়েই তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। তবে টাকা তিনি নিজের কাছে না রেখে ম্যানেজার নিয়োগ করেছেন। তার গ্রামে অন্তত পাঁচজন ম্যানেজারের তথ্য মিলেছে। এছাড়া তার দুই ভাই একসময় ছোটখাটো ব্যবসা করলেও কয়েক বছরে তারাও কোটি কোটি টাকার মালিক হন।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ আমলে গুম ও ক্রসফায়ারের জন্য কিছু কর্মকর্তাকে সিলেক্ট করা হয়েছিল। তাদের একজন আলেপ। তিনি সরকারের যেকোনো অনৈতিক আদেশ পালন করতে দ্বিধা না করায় পুরস্কারও পেয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে দুবারই পদক পরিয়ে দেন।

জানা গেছে, অনেক ব্যবসায়ীকে গুম ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকাও হাতান তিনি। নারায়ণগঞ্জেও তিনি গুমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আর সেই আলেপকে বাঁচাতে প্রভাবশালী মহল উঠেপড়ে লেগেছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, তাকে বরিশাল থেকে আটক করা না হলেও তার ব্যাংক কর্মকর্তা স্ত্রী ওয়াফা নুসরাত গত বুধবার সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে তার স্বামীকে কর্মস্থল থেকে ‘ডিবি পরিচয়ে’ তুলে নেওয়া হয়। এরপর থেকে তার খোঁজ মিলছে না।

বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ নাজিমুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে বলেন, ‘আলেপের বিরুদ্ধে করা একটা মামলার বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিবি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং কথা বলার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। এখানে তুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার ডিবি আলেপকে ফোন করে ডেকে আনে। আলেপ একাই ঢাকায় আসেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে নেওয়া হয় দুইদিনের রিমান্ডে।

আলেপ উদ্দিনের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ১ নম্বর হাড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের পশ্চিম দেবোত্তর (চায়না বাজার) গ্রামে। তার বাবা মৃত অজর উদ্দিন। তিনি বেঁচে থাকতে পাটের ব্যবসা করতেন। দুই বিয়ে করেছিলেন। আলেপ দ্বিতীয় সংসারের সন্তান। এই ঘরে তারা চার ভাই ও তিন বোন। ভাইদের মধ্যে আলেপই উচ্চশিক্ষিত। অন্যরা এলাকায় ব্যবসা করেন। একসময় তাদের ব্যবসা ছোট হলেও আলেপ পুলিশে যোগদানের পর ব্যবসা বড় হতে থাকে।

জানা গেছে, আলেপের ছোট ভাইয়ের নাম আলতাফ হোসেন। আলতাফ আলুর ব্যবসা করতেন। কয়েক বছরে তিনি অনেক সম্পত্তির মালিক হন। অন্তত ১০ কোটি টাকার সম্পত্তি গড়েছেন। ৩০ বিঘা জমিতে পুকুর করেছেন। আলেপের বড় ভাই আবু তাহের ধানের ব্যবসা করেন। তিনিও কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হন। বিষয়টি গ্রামে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে আলতাফ হোসেনকে ফোন করলে তিনি ধরেননি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স শেষে ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি এএসপি হিসেবে পুলিশে যোগ দেন আলেপ। তিনি ৩১তম বিসিএস ক্যাডার। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি র‌্যাব-১১ তে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তাকে লালমনিরহাটে বদলি করা হয়। সেখানে অতিরিক্ত এসপি হিসেবে তিন মাসের মতো দায়িত্ব পালনের পর তাকে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা ইউনিটে বদলি করা হয়। সেখান থেকে তাকে জুলাই বিপ্লবের দুই মাস আগে এসবিতে বদলি করা হয়। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁকে বরিশাল রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়।

অভিযোগ উঠেছে, নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবে দায়িত্ব পালনের শুরুতে কিছু ভালো কাজ করলেও এরপরই নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলেন আলেপ। একসময় নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসী নূর হোসেনের সাম্রাজ্য থেকেও তার কাছে চাঁদা আসতে শুরু করে। সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব-১১ এর সিও তারেক সাঈদ অপকর্মের হোতা ছিলেন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের পর তাঁর মুখোশ উন্মোচিত হয় এবং গ্রেপ্তার হন। কিন্তু আলেপ জুনিয়র অফিসার হয়েও র‌্যাব-১১ এর সিওর অভাব যেন পূরণ করতে সক্ষম হন।