আমার মা

::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

আমার মায়ের নাম অজিফা খাতুন। অজিফা একটি ইসলামিক নাম। যার অর্থ ভরণপোষণ। হজের দিন জন্মেছিলেন তাই দাদা মাজুম আলী সরকার নাম রেখেছিলেন অজিফা খাতুন। বাবা বেলায়েত হোসেন সরকার ও মাতা নেছাতন বিবির ঘরে জন্মেছিলেন আমার মা। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। চার বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে মা মেজ। ধর্মীয় পরিবেশে বড় হয়েছেন। বাড়িতে ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও অনুশাসন ছিল। আমার নানী নেছাতন বিবি একজন ধর্মপ্রাণ বিশুদ্ধ মুসলমান ছিলেন। তবে তাঁর মধ্যে কোনো ধর্মীয় গোড়ামি ছিল না।

প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় আমার মা হয়তো শিক্ষিত না। তবে একেবারেই যে স্কুলে যাননি তেমন নয়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আমাদের ভাই-বোনদের বর্ণমালার হাতেখড়ি মায়ের কাছে। তিনিই আমাদের প্রথম শিক্ষক। সেইসাথে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। বাবা একটু রাগী ছিলেন, ঠিকমতো পড়তে না পারলে বকা দিতেন। মা বকা তো দূরে থাক, কখনো ভুল করেও রাগতেন না। তাই সব ভাই-বোন গোল করে মায়ের কাছে পড়তে বসতাম। অনেক বন্ধুর মাকে দেখেছি সন্তানদের বকতে, এমনকি লাঠি দিয়ে পিটাতে। অথচ আমার মা এমনি একজন, যিনি ছোট থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের কাউকে একটি ধমক পর্যন্ত দেননি।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

মা আমাদের কষ্ট একবারেই সহ্য করতে পারেন না। আমরা কেউ অসুস্থ হলে, কোনো সমস্যায় পরলে মা অস্থির হয়ে যান। এত বড় হয়েছি এখনো জ্বর হলে মা সারারাত মাথার কাছে বসে থাকেন। এত করে বলি, রাত অনেক হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো। কে শোনে কার কথা। এতদিন তো মায়ের এমন পাগলামি ছিল আমাদের নিয়ে, এখন যোগ হয়েছে নাতি-নাতনি। নাতি-নাতনিদের প্রতি মায়ের আদর, মায়া-মমতা, আবেগ, ভালোবাসায় মনে হয় মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম।

মায়ের বয়স যখন তেরো, তখন বাবার সাথে বিয়ে হয়। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে চলে যান। খুব বেশি দিন শ্বশুর বাড়ি থাকতে হয়নি মাকে। পাকিস্তানের করাচিতে বাবার সরকারি চাকরি হলে তিনি মাকে সেখানে নিয়ে যান। বেশ কয়েক বছর মা করাচিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে বাবা, মাকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। মায়ের কাছে আমরা ভাই-বোন করাচির অনেক গল্প শুনেছি। সময় পেলে এখনো মা তাঁর নাতি-নাতনিদের সেই গল্প শোনান।

আল্লাহর প্রতি রয়েছে মায়ের গভীর প্রেম। জন্মের পর জ্ঞান হওয়া থেকে কখনো একটিবারের জন্যও দেখিনি মাকে নামাজ বাদ দিতে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তো তিনি পড়েন, সেই সাথে তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, জাওয়াল, আউওয়াবিন নামাজ পড়াও বাদ দেন না। সকালে অফিসে যাওয়ার সময়ও দেখি নামাজে, ঘরে ফিরেও দেখি তিনি নামাজে। রমজানের রোজা ছাড়াও তিনি হাদিসে বর্ণিত সবকয়টি রোজা রাখেন। বহুবার অসুস্থ হতে দেখেছি তবুও রোজা ও নামাজ বাদ দিতে দেখিনি।

নিজের সন্তান, নাতি-নাতনিদের মতো মা তার ভাই-বোনদেরও ভালোবাসেন। বড় বোন আয়শা খাতুন। তাঁর চেহারার সাথে মায়ের চেহারায় বেশ মিল। অথচ মায়ের ছোট দুই বোন (রুমি ও শান্তি) জমজ হলেও চেহারায় বিন্দু পরিমাণ মিল নাই। বছরের শেষের দিকে মায়ের সাথে যখন নানা বাড়িতে যেতাম তখন সব বোনেরা একত্র হতেন, আনন্দে মেতে উঠতেন। মনে হতো বোনদের যেন এক মহামিলনমেলা।

মায়ের রান্না সব সন্তানের কাছেই প্রিয়। কিন্তুু আমার মায়ের হাতের রান্না পৃথিবীর সেরা রান্না। তাঁর হাতের রান্না খাবারে অতুলনীয় এক স্বাদ। এক কথায় পৃথিবীর সেরা রাঁধনিদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা রাঁধুনি আমার মা। বিশেষ কোনো খাবার নয় মায়ের হাতের প্রতিটি রান্না খাবার আমার কাছে খুবই প্রিয়।

বাসায় তো মা প্রায় প্রতিদিন আমাদের বাথরুমে ঝর্ণা ছেড়ে গোসল করাতেন। নানা বাড়িতে গেলে গোসল করাতে পুকুরে নিয়ে যেতেন। সাঁতার জানতাম না, তাই মা কখনো একা ছাড়তেন না। পুকুর ঘাটে কাঠের তক্তাতে দাঁড় করিয়ে গায়ে সাবান মেখে ছোবা দিয়ে শরীরে ডলা দিতেন। আর বলতেন দেখ তোর শরীর থেকে কত ময়লা বের হচ্ছে। মা গোসল করাতে গিয়ে আমাদের দুষ্টুমিতে দিশেহার হয়ে পড়তেন। ছোটবেলায় মায়ের হাতের গোসল আর সব দুষ্টুমি কতো মজার ছিল কেন যে বড় হলাম।

আমার মায়ের তিন ভাই। বড় মামা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা এ নিয়ে মায়ের অনেক গর্ব। দীর্ঘ নয় মাস অস্ত্র হাতে পাকবাহিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীনের পর বীরের বেশে ভাইয়ের বাড়িতে ফিরে আসার গল্প, মেজ মামার নাটকে অভিনয়ের গল্প আগে তো শুধু আমাদের শুনাতেন, এখন নাতি-নাতনিদের শুনান। আমার মেজ মামা দেলোয়ার হোসেন দুলাল স্কুল জীবনে অনেক নাটকে অভিনয় করছেন, দর্শক নন্দিতও হয়েছেন। বিশেষ করে ত্রিরত্ন নাটকে মেজ ভাইয়ের চরিত্রে তাঁর অভিনয়ে দর্শক ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিল। ছোট মামা এবাদুল্লা সরকার। ছোট বলে সবার কাছে ছিল একটু বেশি আদরের। ছোট মামা একবার নানার হাতে লাগানো কাঁঠালগাছের সবচেয়ে বড় একটি কাঁঠাল মায়ের জন্য আমাদের গাজীপুরের বাসায় নিয়ে আসেন। এত বড় কাঁঠাল, তারপর নানার হাতে লাগানো কাঁঠালগাছ। মা তো ভীষণ খুশি! কিন্তু বিধি বাম। এত বড় কাঁঠাল অথচ ভিতরে একটি মাত্র কোষ। তাও আবার এতই ছোট যে বাসার সবাই হাসতে হাসতে পেট ফুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। সেদিন মায়ের মন খুব খারাপ হয়েছিল, ছোট কোষের জন্যেও নয় আমাদের হাসির কারণে তাও নয়। কষ্ট হয়েছিল আদরের ছোট ভাইয়ের শখ করে এত দূর থেকে কাঁঠাল বয়ে আনা।

আমার চাচা, বাবার ছোট ভাই ছানোয়ার হোসেন সানাল। চাচার জন্মের কয়েক বছর পর দাদি মারা যান। ছোটকালে দাদি মারা যাওয়ায় নিজের মায়ের আদর-ভালোবাসা তেমন পাননি। আমার মা চাচাকে মাতৃস্নেহে আদর করতেন। মা শ্বশুর বাড়ি থেকে নানা বাড়িতে বেড়াতে আসলে, কিছুদিন পর চাচাও নানা বাড়িতে মায়ের কাছে চলে আসতেন।

বাবা মারা যাওয়ার পর মা অনেকটা ভেঙে পড়েন। বাবার কবর স্থান গাজীপুর ছেড়ে মা মানিকগঞ্জ আসতে চাননি। অনেক বোঝানোর পর এক প্রকার জোর করেই নিয়ে আসা হয়। প্রথম কয়েক মাস ভালো লাগেনি। বাসায় আত্মীয়-স্বজনের আসা-যাওয়া, নিয়মিত দেখা সাক্ষাত, কথা-বার্তায় অনেকটা সহজ হয়ে যান। এখন তো মানিকগঞ্জই তাঁর প্রিয়। কারণ প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো আত্মীয়-স্বজন বাসায় মায়ের সাথে দেখা করতে আসেন।

মা ছাড়া সন্তানের জীবন বিষণ্ণ ও বেদনাময়। নয়-দশ বছর বয়সে আমি মর্মে মর্মে তা অনুভব করেছি। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো আতকে উঠি। মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবা দ্রুত তাঁকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করান। মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে কখনো সিসিইউ, কখনো আইসিইউ এভাবে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তিন মাসের অধিক সময় মায়ের চিকিৎসা চলে। এই পুরো সময়টা আমার নানী নেছাতন বিবি মায়ের সাথেই ছিলেন। বাবা সকালে অফিস করে দুপুরে খেয়ে না খেয়ে হাসপাতালে পাগলের মতো দৌড়াদৌড়ি করেছেন। কতদিন আমরা ভাই-বোন এতিমের মতো ঘরে বসে কান্নাকাটি করেছি। তখন মনে হতো যার মা নেই, দুনিয়াতে তার কিছুই নেই। আমাদের ছোট ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের দোয়ায় আল্লাহর রহমতে মা সুস্থ হয়ে যান। সুস্থ হয়ে মা বাসায় ফিরে আসেন। মায়ের ফিরে আসার দিনটি ছিল আমাদের সবার জন্য বড় খুশির দিন, ঈদের দিন।

লেখক: মো. নবী আলম, সাংবাদিক।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net