নাভিদুল হক:
ছোটবেলার বাবাকে নিয়ে আমার স্মৃতি হাতে গোনা। অন্য দশজনের বাবার মতোই আমার বাবাও ছিলেন অনেক ব্যস্ত, জীবনসংগ্রামে ছুটে চলা একজন মানুষ। আমাদের আরো ভালো একটা জীবন দেওয়ার অভিপ্রায়ে তাঁর ছিল নিত্য কর্মযজ্ঞ। যতটুকু সময় পেতেন, এর ভেতর তিনি কত কঠিনভাবে শাসন করতেন—শৈশবের সেই স্মৃতিই বেশি মনে পড়ে।
বেশ বকাঝকা করতেন এবং মাঝেমধ্যে পিঠে মারও পড়ত।
আমি পরিবারের বড় ছেলে। আমার কাছে তাঁর চাওয়া ছিল অনেক। সময় হয়তো দিতে পারতেন না, কিন্তু চাওয়ার শেষ ছিল না। যত রাগ এবং আক্ষেপ—সব ছিল আমারই ওপর। তাঁর চোখে আমি কিছু পারি না। আমার কিছুই তাঁর মনমতো হতো না। আর দশটা বাবার মতোই সব সময় বলতেন, আরো ভালো করতে হবে। কিন্তু লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি সবচেয়ে বেশি যেটা প্রত্যাশা করতেন, সেটি হচ্ছে ভদ্রতা। আমি কিভাবে অন্যদের সঙ্গে ব্যবহার করব; স্কুলে, বাসায়, বাসার বাইরে, সমাজে কিভাবে চলতে হবে; মানুষকে কিভাবে মূল্যায়ন করতে হবে—এসব নিয়ে ছিল তাঁর সব কথা, সব শিক্ষা। একজন রিকশাওয়ালা কিংবা রাজা কাউকে আপনি ছাড়া ডাকা ছিল মানা। আর কাজের ক্ষেত্রে পিয়ন থেকে শুরু করে ওপরের সবাইকে ভাবতে হবে স্যার। কেউ যদি দরজার কাছে থাকে তাকে আগে যেতে দেওয়া, দরজাটা খুলে দেওয়া। কাউকে দেখলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ানো—এসব ব্যাপারে সব সময় শিক্ষা দিতেন। আরেকটা বিষয় সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, তা হচ্ছে তাঁর গল্প। তিনি আমাদের ভাই-বোনদের গল্প বলতেন। মানুষের গল্প। প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে অনেক মানুষের দেখা হতো। তাঁদের জীবনসংগ্রামের গল্প করতেন। এভাবেই আমাদের বেড়ে ওঠা।
বাবা আর মা দুজনই কঠিন পরিশ্রম করতেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যবসার জন্য কাজ করা, তারপর বিভিন্ন অনুষ্ঠান থাকত। বাসাবাড়িতে সব সময় লোকজন থাকত। বাবার অনেক বন্ধু ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম তাঁর সম্পর্কগুলো কত গভীর ছিল এসব মানুষের সঙ্গে। অনেকেই ছিলেন দেশের বড় ব্যবসায়ী অথবা বড় কোনো তারকা, আবার অনেকেই নিতান্ত সাধারণ মানুষ, কিন্তু কখনোই মনে হয়নি কোনো বন্ধুত্ব অথবা সম্পর্কের ভেতর তাঁর কোনো ধরনের স্বার্থ ছিল। ছিল শুধুই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গভীর হয় যখন আমি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে তাঁর গড়ে তোলা কম্পানিতে যোগ দিলাম।
বস হিসেবে বাবা ছিলেন আরো কড়া। আমি কমপক্ষে পাঁচবার চাকরি থেকে লিখিত ইস্তফা দিয়ে অন্য কম্পানিতে চাকরি খুঁজেছি। তা-ও বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করার বিশাল সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বাবা ব্যবসা থেকে বেশি ব্যস্ত থাকতেন ব্যাবসায়িক সংগঠন অথবা সেই সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নিয়ে। নিজের ব্যবসার প্রতি খেয়াল কম, কিন্তু অন্যকে অথবা অন্যের ব্যবসা অথবা একটা পুরো শিল্পকে কিভাবে ভালো করা যায়, এগিয়ে নেওয়া যায়—এসব নিয়ে সব সময় আরো বেশি চিন্তিত এবং ব্যস্ত থাকতেন।
২০০৬ সালে আমি দেশে আসার পর তিনি এফবিসিসিআই এবং তারপর সার্ক চেম্বারের সভাপতি হলেন। তাঁর এই দায়িত্বগুলো শেষ হওয়ার পর আমার ভাবনায় এলো, বাবা মনে হয় এবার নিজের ব্যবসায় মনোযোগ দেবেন, জীবনটাকে উপভোগ করবেন, আমাদের সঙ্গে অনেক সময় কাটাবেন। কিন্তু কিছুদিনের ভেতরেই তাঁর কাছে প্রস্তাব এলো মেয়র নির্বাচনে অংশ নেওয়ার। তিনি আমাদের পরিবারের সঙ্গে বসলেন। আমরা সবাই ছিলাম এর ঘোর বিরোধী। আমরা বললাম, বাংলাদেশের রাজনীতি তোমার জন্য না। তুমি কোনোভাবেই পারবে না। তোমার যে আত্মমর্যাদা, তোমার জন্য কাজ করা অসম্ভব হবে। তুমি এবং আমরা যেভাবে আছি, ভালোই আছি। প্রথমে না করেও তিনি শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিলেন। শুরু হলো মেয়র নির্বাচনের প্রস্তুতি। আমার সৌভাগ্য হয় তাঁর প্রচারণা-পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার। ২০১৫ সাল। তখন সবেমাত্র ইন্টারনেট সবার হাতে হাতে পৌঁছাচ্ছে। ২০১৫-এর মেয়র ইলেকশন সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম ইলেকশন, যেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বড়ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা ছিলাম ডিজিটাল ক্যাম্পেইনের অগ্রদূত। যেহেতু কিছু প্রযুক্তি জ্ঞান আছে, আরো বিভিন্ন প্রযুক্তি যুক্ত করলাম মেয়র নির্বাচনের প্রচারণায়। ভোট হলো। মোটামুটি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলো। বাবা মেয়র নির্বাচিত হলেন।
বাবা যেদিন নির্বাচনে জিতলেন, আমাদের সব আত্মীয়-স্বজন এলেন বাসায়। বাবা আমাকে বললেন, তাঁদের সবাইকে যেন আমাদের বেইসমেন্টের এক জায়গায় বসাই। কেউ যেন বাসার ভেতরে হাঁটাহাঁটি না করে। বাসায় তখন আরো অনেক লোক। আমরা সবাই বেইসমেন্টে বসে আছি বাবার অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ পর বাবা এলেন নিচে। সবাইকে বললেন, ‘তোমাদের সবার সঙ্গে আমার দেখা এখন থেকে মোটামুটি বন্ধ। তোমরা আমাকে এমনি বাসায় পাবে না। আর আমার মেয়র অফিসের ত্রিসীমানায়ও যেন তোমাদের কারো চলাফেরা না দেখি। তোমাদের আনাগোনা দেখলে মানুষ আমাকে ভুল বুঝবে। মানুষ তোমাদের বিভিন্ন কাজ, সুপারিশ—এসব নিয়ে জ্বালাবে। এসব আমি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারব না। তোমরা আমার জন্য দোয়া কোরো, আর জরুরি কিছু প্রয়োজন হলে নাভিদকে বোলো। ’ আমার পরিবারের কারোরই বাবার মেয়র অফিস দেখা হয়নি। আমার চাচা, ফুফু এবং আত্মীয়রা মেয়র অফিসটা দেখেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর।
বাবা বলতেন, ‘মেয়র মানে শুধু মশা মারা, রাস্তার ময়লা পরিষ্কার, আর ভাঙা রাস্তা ঠিক করা; কিন্তু এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু করতে হবে। আমাকে যে কাজ করতে হবে, তা হচ্ছে ১০০ বছরের জন্য ঢাকাকে ঠিক করা। ’ তিনি পরিকল্পনা শুরু করলেন। এত ঘনবসতির ভেতর মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজন ভালো গণপরিবহন এবং পরিষ্কার একটি শহর। থাকবে সুন্দর খেলার মাঠ, প্রতিটা খোলা জায়গায় থাকবে অনেক গাছ, আকাশ থাকবে মুক্ত, থাকবে না ড্রেন অথবা ময়লার গন্ধ। সব কিছুতে থাকবে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার, থাকবে না কোনো দুর্নীতি। সমাজের সব মানুষ পাবে সমান সেবা। গুলশান, বনানী যদি সুন্দর হয়, তাহলে পুরো ঢাকা শহর হতে হবে আরেকটা গুলশান, বনানী ও বারিধারা। ড্রেন বানানো, রাস্তা বড় করা ও নতুন করে করা, ফুটপাত ও বিভিন্ন জায়গা দখলমুক্ত করে শহরকে সুন্দর করার কাজ জোর গতিতে শুরু হলো। এর পাশাপাশি চলল আগামী ১০০ বছরের ঢাকার জন্য কাজ করা। সবচেয়ে বেশি যেটা তিনি চেয়েছিলেন সেটা হচ্ছে, বাসসহ পুরো গণপরিবহনব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে। বর্জ্যব্যবস্থাকে পুনর্ব্যবহারভিত্তিক করা এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন বন্ধ করা। প্রতিটা কাজের পরিকল্পনা করতে হবে ৫০ থেকে ১০০ বছর মাথায় রেখে। দিন যত যাচ্ছিল, বাবা ততই আরো পাগলের মতো কাজ শুরু করলেন। কোনো বিশ্রাম নেই, কখন কী খাচ্ছেন, কখন ঘুমাচ্ছেন—কোনো কিছুরই ঠিক ছিল না। শুধু শহরকে নিয়ে কাজ আর ছুটে চলা। একদিন শুক্রবার দুপুরে খাওয়ার আগে তিনি বাসায় বসে ফাইল সই করছিলেন, আমি একটু রাগই হলাম। শুক্রবার একটা দিন আমরা পরিবার একসঙ্গে একটু বসি একবেলা খাওয়ার জন্য। তা-ও মাত্র ঘণ্টা দুই-তিনের জন্য, এর ভেতর আবার ফাইল সই করা! বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নাভিদ আমি আমার জীবনে এত পরিশ্রম করিনি। জীবনে একেবারে নিচ থেকে উঠে এসেছি, নিজ হাতে সব তৈরি করেছি, কিন্তু এত পরিশ্রম আমাকে করতে হয়নি, যা এখন শহরের জন্য করছি!’ বাবাকে দেখে মনে হলো তিনি অনেক ক্লান্ত, একটু চিন্তিত। তিনি বাসায় যে পরিকল্পনাগুলো করছেন আগামীর ঢাকার জন্য, সেই কাজগুলো কি করতে পারবেন?
কিছুদিন পর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রথমে মাথা ঘোরা আর মাথা ব্যথা। তারপর আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকল। আমরা লন্ডন গেলাম। হাসপাতালে বাবা ভর্তি হলেন চিকিৎসার জন্য। একদিন অচেতন হয়ে পড়লে আর ফেরত এলেন না।
তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন পাঁচ বছর হয়। আমিসহ এই শহর ও দেশের প্রত্যেক মানুষের আক্ষেপ আর প্রশ্ন, কী হতো তিনি যদি আরো কয়েকটি বছর বাঁচতেন? আরো কিছুদিন যদি কাজ করতে পারতেন? কেমন হতো আমাদের শহর? এই শহরে পাঁচ হাজার ঝকঝকে নতুন ইলেকট্রিক বাস চলত লাইন মেনে কোনো ধাক্কাধাক্কি ছাড়া। কোনো বর্জ্য রাস্তায় পড়ে থাকত না। সব কিছু রিসাইকল করে বর্জ্য দিয়ে বিদ্যুৎ অথবা সার হতো। প্রতিটি রাস্তা ও ড্রেন হতো সুন্দর ও প্রশস্ত। সব কিছু হতো সবুজে ঘেরা। থাকত আরো অনেক পার্ক, খেলার মাঠ, হাঁটার এবং সাইক্লিংয়ের জন্য লেন। থাকত শিশু পার্ক, সুন্দর জলাধার। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে শুধু গাড়ি না, চলত বিআরটির মতো গণপরিবহন। ঢাকার আশপাশে অপরিকল্পিত ঘনবসতি এলাকাগুলো নতুন করে তৈরি করা হতো আগামীর গুলশান হিসেবে। থাকত উন্নত ট্রাফিকব্যবস্থা। অনেক পার্কের নিচে থাকত মাল্টিস্টোরেড পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। থাকত নতুন বাস ও ট্রাক টার্মিনাল। নাগরিক তার সব সমস্যার সমাধান পেত তার বাসায় বসে, হাত ফোন থেকে প্রযুক্তির ব্যবহার করে। থাকত না অপরিকল্পিত রাস্তা কাটাকাটি। শহরের সব কাজ হতো জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে। প্রতিটি ছাদে বা রাস্তার আশপাশে খোলা জায়গায় থাকত সবুজের সমারোহ। ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কম হতো। বাচ্চারা সবাই বাসে করে স্কুলে যেত-আসত। শহর শুধু ধনীদের জন্য নয়, শহর হতো সবার। এগুলো ছিল তাঁর কিছু পরিকল্পনা, তাঁর স্বপ্ন।
বাবার সঙ্গে যেদিন শেষ কথা হয়, বাবা আমাকে অনেক কথা বললেন জীবনের ব্যাপারে। আমার জীবনে আরো কী কী দায়িত্ব পালন করতে হবে। তখনো বুঝতে পারিনি এটাই হবে বাবার সঙ্গে শেষ কথা। আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা তুমি তোমার জীবন নিয়ে কি খুশি? তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি অনেক খুশি। আমার জীবন থেকে যা চেয়েছিলাম, তার চেয়েও অনেক বেশি পেয়েছি। আর সবচেয়ে খুশি যে তোমরা তিন ভাই-বোন বড় হয়ে গেছ, মানুষের মতো মানুষ হয়েছ। বাবা না থাকলেও তোমাদের কিছু হবে না। ’
বাবা তুমি খুশি মনে পৃথিবী থেকে চলে গেলে। দুঃখে রেখে গেলে আমাদের ও এই শহরের বাসিন্দাদের…। তুমি সবই পেলে। আমাদের রেখে গেলে একটা সুন্দর শহর না পাওয়ার কষ্টের মধ্যে।
লেখক : সাবেক মেয়র আনিসুল হকের ছেলে পরিচালক, মোহাম্মাদি গ্রুপ
navid@mohammadigroup.com