মেহেরাজ জেবিন ইফতি:
রূপসী বাংলার জীবনানন্দ! বাংলার প্রকৃতিকে মোহনীয়তার মায়াবী অলংকারে সাজানোর এই নিপুণ কারিগরের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুব কমই আছে। কিন্তু কেমন ছিলেন ব্যক্তি জীবনানন্দ! ক’জনই জানেন তার জীবনের চরম টানাপোড়েনের করুণ গল্প! জীবনানন্দের জীবনের এই টানাপোড়েনের গল্পের সাথে নিবিড় যোগাযোগ ঘটাতে চাইলে পড়তে হবে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের অনবদ্য রচনা ‘একজন কমলালেবু’। কিন্তু ঠিক কি কারণে লেখক জীবনানন্দের নাম দিলেন ‘একজন কমলালেবু’! সেটাও এক রহস্য বটে। কেউ কেউ ধারণা করেন জীবনানন্দ জীবনের অন্তিম সময়ে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন। তার সাথেই নাকি এই বইয়ের নামের কোনো মিল থাকলেও থাকতে পারে। অবশ্য এই ধারণার স্বপক্ষে খুব একটা যৌক্তিকতা আছে কি না তা লেখক শাহাদুজ্জামানই ভালো বলতে পারবেন।
তবে ‘একজন কমলালেবু’ বই পড়ে নামের সাথে লেখনীর একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একটি কমলালেবুর ক্ষেত্রে, খোসা ছাড়ালে পাওয়া যায় কতগুলো কোয়া। আবার একেকটি কোয়ায় আছে ছোট ছোট অসংখ্য দানা। অর্থাৎ যতই কমলালেবুর আবরণ সরানো হয় ততই এর ভেতরের খুটিঁনাটি মানুষের সামনে উন্মোচন হয়। ঠিক তেমনি জীবনানন্দের জীবনের ক্ষেত্রেও যতই গভীরে প্রবেশ করা যায় ততই অদ্ভুত সব রহস্যময় তথ্য উন্মোচন হয় আমাদের সামনে। ‘একজন কমলালেবু’ পড়লে এমনই অনেক গোপন রহস্য পাঠকের সামনে প্রকাশিত হয়। পাঠক জানতে পারেন একজন কবির ‘কবি’ হিসেবে পরিচিত হওয়ার পেছনে দুর্গম পথচলার গল্প।
কাব্য, প্রজ্ঞা, রূপকথা, ঘাস, ফুল, পাখি মিলিয়ে এক মায়াবী শৈশব ও কৈশোর কেটেছে জীবনানন্দের। কবি মাতা কুসুমকুমারীর ছায়া তলে এক ছোট্ট হাঁসের ছানার মতো লেপ্টে থাকতেন সর্বক্ষণ। শৈশবে শোনা মায়ের সেই কবিতার লাইন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ একে যেন জীবনানন্দ একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়ছিলেন। কথায় বড় হওয়া তো দূরের কথা, সহজে লোকের মতো স্বাভাবিক কথাই তিনি বলতে পারতেন না। সারা জীবন ছিলেন ভেতর গোটানো, মুখচোরা মানুষ। আর কাজ! সারাজীবন মাকে একাগ্রচিত্তে, ধ্যানমগ্নতায় যে কাজটি করতে দেখেছেন সেটিকেই অলক্ষ্যে তিনি কাজ বলতে বুঝেছিলেন। আর তা লেখা ছাড়া আর কিছুই না। তাই হয়তো নীরবে নিভৃতে আমৃত্যু ওই একটি কাজই করে গেছেন মন দিয়ে। তাই তো, তার মৃত্যুর পরে কলকাতার ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের তার সেই ছোট্ট কামরা থেকে উদ্ধার হল গোটা কয়েক কালো টিনের ট্রাঙ্ক। ওইসব ট্রাঙ্ক থেকে তুতেনখামেনের পিরামিডের গুপ্তধনের মতো উদ্ধার হলো তার লেখা অপ্রকাশিত গল্প, উপন্যাসের রাশি রাশি পান্ডুলিপি। নানা ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে অবশেষে সেসব পান্ডুলিপির জায়গা হয় কলকাতার আর্কাইভে। সেই অপ্রকাশিত লেখার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে উঠে আসলো নতুন এক জীবনানন্দ। যদিও এখনও উদ্ধারপর্ব চলছে, তবু তার প্রকাশিত-অপ্রকাশিত লেখা যোগ করলে দেখা যাচ্ছে তিনি লিখেছেন প্রায় আড়াই হাজার কবিতা, গোটা বিশেক উপন্যাস, শতাধিক গল্প, পঞ্চাশটির ওপর প্রবন্ধ আর প্রায় চার হাজার পৃষ্ঠার ডায়েরি যার নাম তিনি দিয়েছিলেন, ‘লিটারারি নোটস’। জীবনানন্দ তার মত করে সাংকেতিক ভাষায়, ইংরেজি, বাংলা মিলিয়ে লিখতেন তার নোটগুলো। লিটারেরি নোটস মূলত তার দিনলিপি লেখার ডায়রির মত ছিল। যা কখনো হয়েছে তার বন্ধু, কখনো তার ঢাল, কখনো বা তার আত্ম স্বীকারোক্তির জায়গা। ডায়েরিতে তার জীবনের উত্থান-পতন, ভালো-মন্দ, এমনকি বেশ্যাগমন, স্বমেহন, কিংবা কাব্যহিংসার মত অতি ব্যক্তিগত তথ্য, প্রেম-বিষাদসহ তার জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা কিছুই বাদ পড়েনি।
মূলত জগৎ সংসারে জীবনানন্দ ছিলেন একা। একদম একা। তার বন্ধু ছিল না বললেই চলে। স্ত্রী লাবন্যও সব সময়েই তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। ব্যক্তি জীবনানন্দ এবং কবি জীবনানন্দ কোনোটাই তার স্ত্রীকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারেন নি। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর সে কথা লাবণ্য তার আত্মজীবনীতে স্বীকারও করেছেন। লাবণ্য এটাও লিখেছেন যে, সংসারে জীবনানন্দের একমাত্র কৃতিত্ব ছিল নিখুঁত সুন্দর করে বাচ্চাদের পেনসিল কেটে দেওয়া। এছাড়া তেমন কোনো কাজই তার দ্বারা হয়ে ওঠে নি। বারংবার চাকুরিচ্যুত হয়ে জীবনানন্দের বেকার, দিশেহারা অবস্থাও তাদের দাম্পত্যে বিশেষ ছাপ ফেলে। তাছাড়া বছরের পর বছর চাকুরীহীন অবস্থায় তিনি জীবনের কঠিন থেকে কঠিনতম দুর্বিষহ সময়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, চাকরির জন্য মানুষের কাছে কুকুর-বেড়ালের মতো তাড়িত হতে হয়েছে। অর্ধাহার-অনাহারে কাটিয়েছেন কতশত দীঘল রজনী। কখনো কখনো প্রবল অনাহারের সময় চড়ুইয়ের খাবারে পর্যন্ত ভাগ বসাতে চেয়েছেন। হতাশা আর দুর্দশা তাকে বারংবার আত্মহত্যার দিকেও প্ররোচিত করছিল। লেখক শাহাদুজ্জামানের লেখনিতে কয়েকবারই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে এসব দিক।
কবিতা লিখেও জীবনানন্দ জীবিতাবস্থায় খুব একটা প্রশংসিত হতে পারেননি। তার কবিতা প্রশংসা পাওয়ার চেয়ে সমালোচিত হয়েছে বেশি। সমসাময়িক কবিরা প্রায় উঠে পড়ে লেগে থাকতেন তার সমালোচনার জন্য। এমনকি রবীন্দ্রনাথও এ ক্ষেত্রে বিরূপ ধারণা প্রকাশ করেছিলেন। জীবনানন্দ বই প্রকাশ করে তার কাছে পাঠালে তিনি বেশিরভাগই কটাক্ষ করতেন আবার প্রশংসা করলেও তার মধ্যে গুটানো একটা ব্যাপার ছিল। এসব প্রতিকূলতা জীবনানন্দকে আশাহত করলেও লেখা থেকে দূরে সরাতে পারে নি। লেখা তার কাছে ছিল মানুষ হবার সমান্তরাল। নিজের যাবতীয় মেধা, শ্রম ঢেলে প্রকাশ্যে গোপনে ধারাবাহিকভাবে ওই একটি কাজই করে গেছেন তিনি। লোকে না দেখুক, না জানুক, না বুঝুক, তবু খেয়ে না খেয়ে ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে লেখার কাজটা করে গেছেন অবিরাম। জগৎ সংসারে বাকি যে কাজই করবার চেষ্টা করেছেন তাতে নাকাল হয়েছেন বারবার। তাই বাস্তবিকভাবেই তিনি লাবণ্য আর তার পরিবারের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি, ওই কিছু ধূসর পান্ডুলিপি ছাড়া। যদিও অবশ্য তিনি অবিরাম চেষ্টা করে গেছেন জীবন আর জীবিকার একটা সমীকরণ ঘটাতে। একটা ন্যুনতম বৈষয়িক বৃত্তান্ত তৈরি করতে। কিন্তু অক্ষর দিয়ে দ্বিতীয় একটা জীবন গড়ার তীব্র ইচ্ছে তাকে বারবার অন্যমনস্ক করেছে।
জীবনানন্দের জীবনের প্রায় পুরোটা কেটেছে আনন্দহীন এক উষর মরুভূমিতে। আগেই বলেছি হতাশাগ্রস্থ সেই নিরানন্দ জীবনকে তিনি প্রায়ই আত্মহত্যা করে মুক্তি দিতে চাইতেন। ১৯৫৪ সালে এসে যেন নিজের ভিতরে বাস করা সেই আত্মঘাতী চিন্তাকেই সত্যি করে তুললেন। খুব রহস্যময় মৃত্যু হয় জীবনানন্দের। ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর আহত হলে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। যদিও বলা হয় তিনি নাকি এক প্রকারে ইচ্ছে করেই ধরা দিয়েছিলেন ট্রামের ক্যাচারে। সেখানে কোনো সুরাহা না হওয়ায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু সেখানেও থেকে যায় প্রশ্ন! এটা কি আত্মহত্যা, নাকি হত্যা!
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, জীবনানন্দ মোটামুটিভাবে নিশ্চিত ছিলেন তার লেখনী সমসাময়িক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও একদিন নিশ্চয়ই তার লেখনীর কদর করবে সবাই। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে তাকে। তবে এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তিনি মনে মনে তার জন্য প্রস্তুুতও ছিলেন। এমনকি মনে গভীর গোপন আশা ছিল একদিন হয়ত গ্যেটে, ইয়টসের মত বড় সাহিত্যিক হবেন। যদিও জীবনের শেষে এসে হতাশার চরম পর্যায়ে তার কিছুটা মোহভঙ্গ হয়। তিনি যা লিখতে চেয়েছিলেন তা পারেননি বলে স্বীকার করে নেন কিন্তু তার কবিতা নিয়ে একটি নিজস্ব অহংকার সবসময়ই ছিল। কারণ তিনি তার কবিতাকে আগত কোন যুগের পাঠকের জন্য লিখছেন ভাবতেন। কখনো ভাবেননি, হয়ত আমিই ঠিক লিখছি না! এই একটিমাত্র জায়গায় তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। যদিও তার বিশ্বাস যে কতটুকু যৌক্তিক তা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। বরং তিনি যে সত্য ছিলেন তা আজ প্রমাণিত। তার মৃত্যুর এতদিন পরে এসে তিনি আরও বেশি বেশি আলোচিত। বস্তুুুত যতই দিন যায় মানুষের তার প্রতি আগ্রহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ততই বাড়তে থাকে।
ধন্যবাদ জানাতে হয় শাহাদ্দুজ্জামানকে, যিনি জীবনানন্দকে নতুন রূপে চিনিয়েছেন আমাদের। কী সাবলীল ভাষায় ফুটিয়ে তোলা এই লেখনী যা পড়তে এবং আলোচনা করতে কিঞ্চিত বিরক্তি আসবে না। সময়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে তিনি মত্ত হয়েছেন ফ্ল্যাশব্যাক এবং ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ডের খেলায়। লেখার ফর্মকেও হয়ত কিছুটা তিনি ভাঙতে চেয়েছেন, দিতে চেয়েছেন বহুমুখী মাত্রা। বস্তুুত বাংলা কাব্যের মোড় ঘোরানো এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে জানার জন্যে ও বোঝার জন্যেও বইটির বিকল্প নেই। তবে এটি আসলে কি একটি উপন্যাস, নাকি একটি জীবনকাহিনী, নাকি একটি ক্রিটিকাল বিশ্লেষনী সেটি পরিষ্কার না হলেও, নিঃসন্দেহে বলা যায়, ‘একজন কমলালেবু’ একটি গবেষণামূলক লেখনী যা বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
(কৃতজ্ঞতা: সারাবাংলা)