‘আমরা সাবধান না হলে দুর্ভিক্ষ হবেই’

::
প্রকাশ: ২ years ago
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক: 
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সপ্তম গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি’র প্রথম উপাচার্য ছিলেন। বিশ্ব পরিস্থিতি ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সে প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন।

করোনা মহামারির শুরুতে বর্তমান সংকটের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। প্রধানমন্ত্রী এখন দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশঙ্কাকে কীভাবে দেখছেন?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: প্রধানমন্ত্রী মূলত গোটা পৃথিবীর কথা আমলে নিয়ে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ তো পৃথিবীর বাইরের কোনো রাষ্ট্র নয়। প্রভাব তো পড়বেই। আমরা সাবধান না হলে দুর্ভিক্ষ হবেই।

আপনি দেখেন, গত কয়েক বছরে দেশে পণ্য আমদানি যেমন কমেছে, আবার কতগুলো খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদনও কমেছে। প্রধানমন্ত্রী মূলত এ কথাটাই বলেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, আমাদের আরও ইফোর্ট (জোগান) দিতে হবে। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাড়াতে হবে উৎপাদন।

প্রকৃতি নামের মাকে যদি আমরা রক্ষা করতে পারি, তাহলে প্রকৃতিই আমাদের রক্ষা করবে। প্রকৃতির ওপর আমাদের মায়া বাড়াতে হবে। সব রোবট বা মেশিন দিয়ে করতে হবে, এই নীতিও ছাড়তে হবে।

পরিস্থিতি তাহলে নাজুক বলা যেতেই পারে?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: বৈশ্বিক সংকট তো দৃশ্যমান। তবে আমরা যারা দেশি-বিদেশি ভাষ্যকর এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করছি, তারা বেশ কিছু সূচক আমলে নিয়ে বলছি। আমরা সবাই বলে এসেছি, যারা আমাদের অবস্থান শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার বা পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করেন, তাদের কোনো ধারণা নেই। আমাদের অবস্থান অবশ্যই শক্তিশালী। আমাদের অর্থনীতির স্তম্ভ অনেক বেশি শক্তিশালী।

আমাদের নেতৃত্বে কিছুটা ভুল-ত্রুটি আছে বটে। যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের দলেও সমস্যা আছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমাদের সামগ্রিক নেতৃত্ব খুব মজবুত।

বৈশ্বিক সংকটের কথা বলছেন। আসলেই কি পৃথিবী দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: গোটা পৃথিবীতে উৎপাদন কমছে। আর রাশিয়া-ইউক্রেনের অর্থহীন এই যুদ্ধ পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদন এবং সরবরাহ আরও কমিয়ে দিয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধটা কারা সাজিয়েছে এবং কেন এভাবে ধ্বংসের খেলায় মত্ত হলো তাই বুঝতে পারলাম না।

কেউ না কেউ তো এই যুদ্ধ সাজিয়েছে। যারা অস্ত্রের ব্যবসা করেন, তাদের জন্য যুদ্ধ আশীর্বাদ। যুদ্ধই তাদের লাভ। যুদ্ধবাজরা এর বাইরে পৃথিবীকে দেখতে চায় না।

আমেরিকার অর্থনীতি মিলিটারি কমপ্লেক্সের ওপর নির্ভর করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকা সুবিধা নিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আমেরিকা এখানে একক ভূমিকা পালন করছে- এমনটি বললে একতরফা বলা হবে। যুদ্ধটা শুরু করেছে রাশিয়া। এখানে রাশিয়া-আমেরিকা সমানভাবে দায়ী। দায় অন্যদেরও আছে। যুদ্ধ লাগানো সহজ। কিন্তু থামানো বড় কঠিন। এই যুদ্ধে পৃথিবীতে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে, তা দুটি শিবির কোনোভাবেই বুঝতে চেষ্টা করছে না।

আমাদের জমি এখনো উর্বর আছে। এখানকার কিষাণ-কিষাণি খাদ্য উৎপাদন করেই যাচ্ছে শত সমস্যার মধ্যে। শ্রমজীবী মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তাদের আমরা ভর্তুকিটা অব্যাহত রাখতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব।

সরকার ডিজেল-সারের দাম আরও বাড়ালো। কৃষক তো বেকায়দায়?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: যখন ডিজেলের দাম বাড়ানো হলো আমি এর তীব্র বিরোধিতা করেছি। এখনো আমি বিরোধিতা করছি। ডিজেল দিয়ে আপনি মালামাল পরিবহন করেন। ডিজেল দিয়ে আপনি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন। আপনাকে এসবের বিকল্প ভাবতে হবে।

আবার বৈশ্বিক পরিস্থিতিও বুঝতে হবে। এর আগে আমাদের নিজেদের শোধরাতে হবে। শ্রমজীবী মানুষ যেন বেশি করে কাজ করতে পারে এবং তার শ্রমে মূল্যায়ন যেন যথার্থ হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থপাচার, মানিলন্ডারিং ঠেকাতে হবে। এখানে ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থ পাচারকারীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। মানিলন্ডারিং, ঋণখেলাপি, করখেলাপি- এই তিনটির বিষয়ে সরকারকে আরও সজাগ হতে হবে। এগুলো একই সূত্রে গাঁথা। এসবে ব্যবস্থা নিলে আসন্ন সংকট আমাদের কাছে তুচ্ছ মনে হবে।

আপনি উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের কৃষিজমি তো কমে আসছে। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের উন্নয়ন আবাদি জমির ওপর চাপ বাড়িয়েছে। জমির এই সংকট রেখে সামনের সংকট মোকাবিলা সম্ভব?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: প্রকৃতি নামের মাকে যদি আমরা রক্ষা করতে পারি, তাহলে প্রকৃতিই আমাদের রক্ষা করবে। প্রকৃতির ওপর আমাদের মায়া বাড়াতে হবে। সব রোবট বা মেশিন দিয়ে করতে হবে, এই নীতিও ছাড়তে হবে। আমাদের জীবনীশক্তি, শ্রমশক্তি যদি কাজে লাগাতে পারি তাহলে সংকট মোকাবিলা করা সহজ। কারণ এতে মানুষে মানুষে সমতা আসবে। প্রত্যেকের কাজের মূল্যায়ন হবে। মানুষ বেঁচে থাকার শক্তি পাবে।

আমাদের গণমাধ্যমে সংকটের কথা বড় করে দেখানো হয়। এর মানে এই নয় যে, আমি সমস্যাকে খাটো করে দেখাতে চাইছি। সমস্যা আছে। কিন্তু সমাধানও আছে। ভয় বেশি দেখানো হলে মানুষ শক্তি হারায়। মানুষ প্রকৃতির কাছে ফিরুক, দুর্ভিক্ষ হবে না। সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নেই। কৃষকের, শ্রমিকের উপযুক্ত সম্মান দিতে হবে। প্রয়োজনে খাদ্য উৎপাদনে আরও ভর্তুকি দিতে হবে। সাম্যবাদ ফিরিয়ে আনতে হলে শ্রমের মূল্য দিতেই হবে। উৎপাদন, পরিবহন আর বিপণনে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য সমবায় জরুরি। তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীর খবরদারি দূর হবে।

আমাদের কৃষকরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রম দিয়ে আসছে। কিন্তু কৃষকরা তার শ্রমের মূল্য পায় না। আমাদের এখানে এক শতাংশ লোকের কাছে ৭০ শতাংশ সম্পদ। আর দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশে এক শতাংশ লোকের কাছে ২০ শতাংশ সম্পদ রয়েছে।

এমন চরম বৈষম্য নিয়ে কোথায় যাবো আমরা?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: এমন বৈষম্যের কারণেই আমাদের বারবার ঠেকতে হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বৈষম্য তীব্র হতে থাকে। এসময় দেশ পাকিস্তানি ভাবধারায় চলে যায়। তখন শাসকরা ভেবেছিল, বাঙালি বা বাংলাভাষী মানুষের আবার রাষ্ট্র কীসের? বাঙালির চেতনা, আদর্শকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হলো। পাকিস্তানি ভাবধারা আগে ভাঙতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিও তো দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকলো?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আমি-আপনি যা বলছি, তা সহজ। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে অনেককে নিয়ে চলতে হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিছু কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে হয়। এই ছাড় দিতেই হবে।

তবে আমরা আশা করতেই থাকব, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের বাঙালিয়ানা যেন পোক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যেই মুক্তি। আমি আশাবাদী মানুষ। সংকট কেটে যাবেই।

কৃতজ্ঞতা: জাগো নিউজ
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২২