অরাজনৈতিক সেলিব্রিটিদের এমপির লালসা

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ৯ মাস আগে

‘ইয়ে তো স্রেফ ট্রেইলার থা, পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। জামিনে কারাগার থেকে বেরোনোর পরদিন আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে ঝালকাঠি-১ আসনে ইতিমধ্যেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। ইতিপূর্বে মুক্তিযোদ্ধা, মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম যিনি কথায় কথায় নীতিকথা, দেশের কল্যাণের কথা, স্বাধীনতার ইতিহাস শুনাতেন।

কিন্তু হায়! আজ তিনি নিজেই ইতিহাস। কল্যাণ পার্টির নেতা হিসেবে নিজের কল্যাণই আগে বেছে নিলেন। ভাবখানা এমন যে, চোরের সাথে না পেরে আমিও চুরি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এরশাদ আমলে জনৈক নেতা জ্বালাময়ী ভাষণের পরদিনই এরশাদের দলে যোগ দিয়েছিলেন। ক্ষমতার লোভ এমন যে, সারাজীবনের অর্জন, নীতিকথা যেখানে মূল্যহীন। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে মনোনয়ন কিনেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান।

বলছিলাম, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। চমক চলছে, নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশে নানামুখী চমক দেখা যাবে। এ পর্যন্ত যতোটুকু ঘটেছে তা মাইনর! অপেক্ষা করুন, আরো অনেক চমক আসছে! কারণ, ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে মনোনয়ন পেতে ৩ হাজার ৩৬২ জন মনোনয়ন সংগ্রহ করছেন। তার মানে প্রতি আসনে গড়ে ১১ জনের বেশি দলের মনোনয়ন পেতে চান। যাকে বলতে হয়, মনোনয়ন ফরম কেনার হুড়োহুড়ি।

ব্যাপারটাকে ‘হুড়োহুড়ি’ বলতেই হচ্ছে। কারণ, মনোনয়ন কেবল যদি রাজনীতিবিদরা কিনতেন, তা হলে সেটাকে ‘উৎসব’ বা ‘ধুম’ বলা যেত। আমরা মনে করি, মনোনয়নের বিষয়টিই চুড়ান্ত নয়। সর্বশেষ দলীয় সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হবে। ১৪ দলের শরিক, জাতীয় পার্টি, এমনকি অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, এমএল, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা, জাকের পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত আন্দোলন, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট নবগঠিত যুক্তফ্রন্টসহ আরো দলের জন্যও আসন ছাড়তে হবে। নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ ৩০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে প্রার্থী হয়েছেন ২ হাজার ৭৪১ জন। এছাড়া জোটের কারণে দলের বাইরের অনেককেও হয়তো নৌকা প্রতীক দিতে হবে। ফলে শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন কাঠামোর পিকচার কী হবে, তা দেখতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, উকিল আব্দুস সাত্তার, সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান তাদের তো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাদের কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই সেরকম অরাজনৈতিক সেলিব্রিট, অভিনয়, গান থেকে ক্রিকেট তারকা ও নানান শৈলীর কলাবিদ স্টারদের তুমুলভাবে নির্বাচনী মাঠে ঘনঘটা লক্ষ্যণীয়। এমপি হওয়ার দৌড়ে শামিল হতে তারা রীতিমতো ভিমরি খেয়ে পড়ছেন। জনগণ যে তাদের ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে তাও নয়।

সব হয়েছিস ‘এমপি’ হয়েছিস ব্যাটা? ‘না’। ‘তাহলে জীবনটা যে তোর ষোল আনাই মিছা’! নেতা, চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী হবার জন্য সবাই ব্যস্ত, সবাই সুযোগ সন্ধানী। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায় বিচার, শান্তি রক্ষায় ত্যাগী নেতা আছে কতজন? এমনতর সুযোগ পাওয়ার কারণেই গড়ে উঠেছে, সিন্ডিকেটধারী কারবারী, ভেজাল কারবারী, টাকা পাচারকারী ও দেশে স্বৈরতান্ত্রিকতার মজবুত কাঠামো।

সর্বশেষ যতো অপরাধই করুক ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিলে নিমিষে পাপমুক্ত! রাজনীতি করার স্বাধীনতা সবার আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ জাতির, রাজনীতিতে নীতি আদর্শ, নৈতিকতা না থাকার কারণে, গণতন্ত্রহীনতার কল্যাণে যদু, মধু, কদু, সব মাকাল ফলরা হয় খবরের শিরোনাম, বনে যায় ১৮ কোটি মানুষের আইন প্রণেতা! ভিলেন ও হিরো আলমরা নমিনেশন কেনার সাহস দেখায়। এর পরিণতি আজ অথবা কাল ক্ষমতাসীনদের অবশ্যই ভোগ করতে হবে।

খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আতি, পাতি, সিকি সব নেতারা এমপি হতে চায়।’ সবাই ধরে নিচ্ছেন নৌকা প্রতীক পেলেই এমপি হওয়া নিশ্চিত।

তাই মূল পরিশ্রমটা হলো নৌকা প্রতীক নিশ্চিত করা। একটি নাটক রয়েছে ‘বাবা আমি মন্ত্রী হবো’। কারণ, একবার এমপি, মন্ত্রী হতে পারলেই রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত। এমনকি কয়েক প্রজন্মের আখের গোছানো সারা।

তবে আমি [লেখক] ব্যক্তিগতভাবে সদাচার আইনজীবী, সৎ পুলিশ ও ডাক্তারদের রাজনীতিতে আসাকে স্বাগত জানাই। কারণ, আইনজীবী, ডাক্তার, পুলিশগণ দেশের মানুষকে বুঝেন-দেখেন; সময়ের প্রয়োজেন জনগণের কষ্ট কী, চাহিদা কী, প্রত্যাশা কী, কী করা দরকার। থানা, আদালত, হাসপাতালে গেলেই বোঝা যায়, কেমন আছে দেশ, কেমন আছে দেশের মানুষ, কী তাদের চাওয়া, কী তাদের আকুতি, কী তাদের হাল-হকিকত।

মেঘ যেমন আলোকে সরিয়ে দেয়, কালো টাকা যেমন সাদা টাকাকে সরিয়ে দেয়, এভাবে যদি অন্য শ্রেণি-পেশার মানুষেরা এসে এমপি হয়, তাহলে যারা ফুল টাইম রাজনীতি করেন, দেশ ও জনগণকে নিয়ে ভাবেন তাদের কী হবে? যার যা করার, কিংবা যার যে যোগ্যতা আছে, তার সেটা করাই ভালো। রাজনীতিবিদদের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও সেবার ইতিহাস থাকতে হবে। দেশের নন্দিত, আলোচিত, সমালোচিত তারকারা রাজনীতিতে যোগ দিয়ে কোনো অন্যায় করেননি। প্রশ্ন হলো, জনসেবা ও দেশের জন্য কাজ করতে হলে কি এমপি হতে হয়? রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে গভীর রোগবালাই বাসা বেঁধেছে, এর সমাধান কী? কার কাছে?

আমাদের এ সাব-কন্টিনেন্টে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের প্রারম্ভটা হয়েছে যাদের প্রযত্নে হাত ধরে, তাদের সবাই পূর্ণাঙ্গ সময়ের জন্য রাজনীতিবিদ ছিলেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সবাই মুখ্যত রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাজনীতিবিদরা তো ৪০/৫০ বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটা পর্যায়ে এসে থাকেন। অন্যদের কি তেমন কোনো অভিজ্ঞতা আছে? যেকোনো কাজের একটি প্রোসেস থাকে। প্রথমে জমি তৈরি, এরপর বীজ বপন, সার-ওষুধ প্রয়োগ, নিড়ানি, কোপানি। এরপর জমিতে ফসল ধরলে ঘরে তোলা যায়। রাজনীতির প্রক্রিয়াগুলোও এমন হওয়াই উচিত নয় কী?

দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড় করানো হয়েছে যে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে এখন আর ভোটারের মন জয় করে আসতে হয় না বলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পরও কোনো অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন চিন্তা থাকে না। এসব দেখলে মনে হয় রাজনীতি আর এখন আর রাজনীতি নেই! উড়ে এসে জুড়ে বসা আর কি! একজন ৩০/৪০ বছর দল করেও নমিনেশন পাবে না, আর ভিন্ন পেশার একজন হুট করে এসে নমিনেশন পেয়ে যাবে। আর্থিক চাহিদা মেটাতে পারলেই হলো। এটা যেকোন রাজনৈতিক দলের জন্য দেউলিয়াপনা! কোনো গণতান্ত্রিক দল থেকে এটা প্রত্যাশিত নয়। দল ও দেশের চেয়ে যদি ব্যক্তি বড় হয়, তবে সে দলের ভবিষ্যত অন্ধকার।

এখন কে কত বছর মাঠের রাজনীতি করে এসেছে, দলের জন্য কার ত্যাগ কত বেশি, কিংবা জনগণের সঙ্গে কার সম্পৃক্ততা আছে, সেগুলো দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাবেক আমলা, উকিল, চিকিৎসক, পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এগিয়ে থাকেন প্রতিযোগিতার দৌড়ে। এমনও দেখা যায়, মনোনয়ন পাওয়ার আগে দলের নেতা-কর্মীরাও তাদের প্রার্থীকে চেনেন না। ফলে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকুক আর না-ই থাকুক, যে কেউই সংসদ সদস্য হতে চান।

ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ক্রিকেট, সিনেমা কিংবা সংগীতজগতের সেলিব্রিটিদের পদচারণা কয়েক দশক ধরেই বেড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেই প্রবণতা বাংলাদেশেও বহুগুণ বেড়েছে। যদিও পাকিস্তানের ক্রিকেট তারকা ইমরান খান পার্টি তৈরী করে রাজনীতিতে এসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

স্বাধীনতার স্বফল স্বদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর দল, ৭৫ বছরের পুরনো দল জনমতকে ভয় পায়, ভাবা যায়! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ৭৫ পরবর্তী সময়ে কোন্দল, বিভাজনের মত বিষয়গুলো দলটির অগণন নেতা-কর্মীদের জন্য ভীষণ বেদনার ও অসহনীয় কষ্টের। আওয়ামী লীগ ভোটচোর, আওয়ামী লীগ ভোটডাকাত, আওয়ামী লীগ ক্ষমতার জবরদখলকারী, আওয়ামী লীগ নিশিরাতের ভোটের উদ্ভাবক, আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী, আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট, এ কথাগুলো কি আওয়ামী লীগের সাথে যায়? কিন্তু যারা প্রকৃত অর্থেই আওয়ামী লীগকে মানুষের ভালবাসার দল হিসেবে দেখতে চান, মানুষের নির্ভরতার বাহন হিসেবে দেখতে চান নৌকাকে, তাদের বুকের ব্যাথা, মনের কষ্ট কে শুনবে?

লেখক: মোহাম্মদ আবু নোমান।