অকৃতজ্ঞ সন্তানের মঙ্গল কামনায় বৃদ্ধ পিতা

:: মোহাম্মদ নবী আলম ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

বৃদ্ধ পিতাকে অনাহারে রাখা, ঘর থেকে বের করে দেওয়া, বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা, অবহেলা করা সন্তানের প্রতি পিতা সব সময় মঙ্গল কামনা করে। এমন পিতা টিভি, সিনেমায় বহুবার দেখেছি, পত্রিকায়ও পড়েছি। কখনো বাস্তবে দেখিনি। ত্রিশ সেপ্টেম্বর শনিবার, ২০২৩ রাত আনুমানিক সোয়া নয়টায় এমন এক পিতাকে বাস্তবে দেখেছি । অকৃতজ্ঞ সন্তানের প্রতি তার মঙ্গল কামনা ও ভালোবাসা অনুভব করেছি।

সেদিন উবারের অপেক্ষায় বেইলি রোডে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে। এমন সময় একজন হাত বাড়িয়ে টাকা চাইলেন। প্রথমে পাত্তা দিলাম না। আবার নাও করলাম না। তখনো মোবাইলে উবারের চেষ্টা করছি। একটি উবারের লোকেশন আশপাশে দেখাচ্ছে। দূরত্ব ছয় মিনিট। ড্রাইভারও কোনো রিপ্লাই দিচ্ছে না। তখন আমার সাথে ছিলেন ড. জিলানী ও রায়হান আহমেদ। উবারের লোকেশন দেখছি আর ওদের সাথে কথা বলছি। লোকটি তখনও যায়নি। আবারও সাহায‍্য চাইলেন। এবার লোকটির দিকে তাকালাম। পরনে লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি। বয়স ষাটের মতো হবে। জিজ্ঞেস করলাম টাকা দিয়ে কি করবেন? তিনি হাতে থাকা একটি ইনহেলার দেখিয়ে বললেন, এটি কিনবো। এও বললেন, তার কাছে এক শ টাকা আছে, আরও সাড়ে তিন শ টাকা হলে তিনি তা কিনতে পারবেন।

হঠাৎ, কয়েক মাস আগের একটি ঘটনা মনে পড়লো। সাভার রেডিওকলোনী বাসস্ট‍্যান্ডে নেমে অফিসের দিকে যাচ্ছি। তখন সময় সকাল এগারোটা। পথেই মধ‍্যবয়স্ক একজন বললেন, তিনি এখনো কিছু খাননি। নাস্তার জন‍্য দশ টাকা চাইলেন। আমি না করলাম। মধ‍্যবয়স্ক লোক এখনো খায়নি। লোকটাকে পিছনে ফেলে খানিকটা সামনে এগিয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর মনটা নাড়া দিয়ে উঠলো। পিছনে ফিরে লোকটার কাছে গেলাম। বললাম, চলেন সামনে হোটেল আছে, সেখানে বসে নাস্তা খাবেন। লোকটি এখন খাবেন না। বললেন, দশ টাকা দিলেই হবে, নিজেই খেয়ে নিবে। আমিও নাছোড়বান্দা। বললাম, নাস্তা খাওয়ার জন‍্যই তো টাকা চাইলেন, দশ টাকায় তো নাস্তা হবে না। আপনি চলুন, যা খেতে চান খাওয়াবো। লোকটি কিছু না বলেই চলে গেলেন। ঠিক পরের দিন একই জায়গায় লোকটাকে দেখতে পেলাম। গতকালের মতো আজও তিনি মানুষের কাছে একইভাবে টাকা চাচ্ছেন। বোঝতে পারলাম নাস্তা খাওয়ার কথা বলে জনসাধারণকে বোকা বানিয়ে এভাবেই টাকা নিয়ে থাকেন। এটা নতুন ফন্দি।

তাই আজকের লোকটির কথায় আমার সন্দেহ হলো। তাকে বাজিয়ে দেখার জন‍্য বললাম, এটার দাম কত? তিনি বললেন, সাড়ে চার শ টাকা। লোকটিকে বললাম, ওই এক শ টাকা দিন আপনাকে ওষুধ কিনে দিব। ভেবেছিলাম লোকটি এই কথা শোনে চলে যাবে। তিনি গেলেন না। বরং খুশি হলেন, চোখে-মুখে আনন্দের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম। আমি বললাম, আশপাশে কোনো ওষুধের দোকান আছে? লোকটি বললেন, একটু সামনে কয়েকটি দোকান আছে। আমি জিলানী ও রায়হানকে বললাম, দেখেন তো দোকান আছে কি না? ওরা আশপাশে কোনো দোকান দেখতে পেল না। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম ওষুধের দোকান কোথায়, ওনারা বললেন সামনের দিকে গেলেই পাবেন। দূর দেখে আর গেলাম না। লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার বাড়ি কোথায়? উত্তরে বললেন, সিলেট। সিলেট থেকে এখানে কেন? তিনি বললেন, ছেলের কাছে এসে ছিলাম। ছেলে আমাকে এক শ টাকা দিয়ে বিদায় করে দিছে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ছেলে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি থাকে। আমার কোনো খোঁজ নেয় না। কোথায় থাকে বলতেই তিনি বললেন, মিরপুর কবরস্থানের কাছে। এমন অকৃতজ্ঞ সন্তানের কথা শোনে রাগ উঠে গেল। আমি জিলানী ও রায়হানকে বললাম, উনাকে নিয়ে চলেন ছেলের কাছে যাব। ছেলেকে বেঁধে পিটাবো। এরপর পুলিশে দিব। লোকটি এই কথা শোনে কাকুতি মিনতি শুরু করে দিলেন। কান্না কান্না অবস্থা। আমার হাত ধরে বলতে লাগলেন বাবা, ওকে মাইরেন না, পুলিশেও দিয়েন না। মারলে ছেলে ব্যথা পাবে। পুলিশ ছেলেকে জেলে দিয়ে দিবে। আপনারা শুধু একটু ভালো করে বুঝিয়ে বইলেন, যেন আমারে মাসে মাসে ওষুধ কিনার টাকা দেয়। আমি আর কিছুই চাই না। আমি বললাম না, সেটা তো হবে না আগে মারব, তারপর বোঝাবো। আপনি যাবেন কি না বলেন? লোকটি বললেন, যাবো। তবে বাবা আপনারা আমার ছেলেকে মাইরেন না। শুধু বুঝিয়ে বললেই হবে। ভাবতে লাগলাম, দূর থেকে আসা বৃদ্ধ পিতাকে এক শ টাকা দিয়ে বিদায় করে দেওয়া ছেলের প্রতি পিতার তো ক্ষোভ থাকার কথা, দেখছি ঠিক উল্টো। নিজে কষ্ট পেয়েছে সেটা বেমালুম ভুলে গেলেন। মারলে ছেলে ব্যথা পাবে, সেই ব্যথা বৃদ্ধ পিতার বুকে গিয়ে লাগবে।

বৃদ্ধ লোকটিকে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটু পরেই উবারের গাড়ি এসে গেল। আগের ঘটনার অভিজ্ঞতায় সন্দেহ তখনো কাটেনি। সন্দেহ দূর করতে ছেলের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে ওঠতে বললাম। ভেবেছিলাম ওঠবে না, কিন্তু না, লোকটি সত্যিই গাড়িতে ওঠার জন্য এগিয়ে আসলেন। মনের সন্দেহ দূর হলে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আপনাকে যেতে হবে না। লোকটিকে ওষুধ কিনে দেওয়া হলো না। তবে, ওষুধ কিনার টাকা হাতে দিয়ে আমরা গাড়িতে ওঠে পরলাম। গাড়িতে বসে ভাবতে লাগলাম পিতার এমন ভালোবসা ও মঙ্গল কামনা কোনোদিন অকৃতজ্ঞ সন্তানের কানে কি পৌঁছাবে?

লেখক: মোহাম্মদ নবী আলম, লেখক ও সাংবাদিক।