ঢাকার প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক। তখনো তিনি সম্পাদকের পদে বসেননি। একটা প্রয়োজনে তাঁকে পাশ্চাত্যের দেশে থাকতে হয়। সেখানে তিনি ইউরোপের এক নারীর প্রেমে পড়েন। একদিন বিদেশিনীকে জানান, তাঁর মা অসুস্থ, ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি, তাঁকে ঢাকায় ফিরতে হবে। বৃদ্ধা মা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি, চিকিৎসা চলছে, মৃত্যু জীবনের জন্য স্বাভাবিক- এরপরও এতো দূরে থাকা এক ছেলের তাঁর কাছে ফিরে আসার ‘হন্তদন্তের’ মানে কী, তা ইউরোপীয় প্রেমিকা বুঝতে পারছিলেন না। আলাপ প্রসঙ্গে তিনি প্রেমিকের কাছে জানতে পারেন, বাংলাদেশের কেউ মৃত্যু পথযাত্রী হলেও স্বজনরা তাকে দেখতে আসেন। পাশে বসে ধর্মগ্রন্থ পাঠ, সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেন। তার কাছে ভুল-ভ্রান্তিকর আচরণের ক্ষমা চান। স্রষ্টার কাছে তার আয়ু বাড়াতে কান্নাকাটি করেন।
বেশিরভাগ পাশ্চাত্যের জীবনে বাবা-মা, ভাই-বোনসহ স্বজনদের থেকে যে দুরত্ব থাকে; বাংলাদেশের জীবনগুলোতে সাধারণত তা নেই। এখানকার জীবনে স্বজনদের সঙ্গে দুরত্ব এলেও চিরায়ত বন্ধন মুছে যায়নি। ঢাকার সাংবাদিকের বিদেশিনী প্রেমিকা এসব শোনে বলেন, পাশ্চাত্যের সততা আর তোমাদের পারিবারিক বন্ধনের মিলন ঘটে সবখানে ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবীটা রাতারাতি অনেক সুন্দর হয়ে ওঠতো। আধুনিকতার দাপটে, জীবনের প্রয়োজনে আপনজনদের থেকে আমরা দূরে থাকি বটে, পারিবারিক বন্ধন একেবারে মুছে দিই না। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে কেউ ধর্মান্তরিত হলে জন্মদাতা, লালনপালনকারীকে অস্বীকার করি না। বাবা-মা একটা ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রাখলে ‘উগ্র’ অ্যাখ্যা দিয়ে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চর্চা আমাদের বেলায় স্বাভাবিক বিষয় নয়।
সদ্য মৃত সংবাদকর্মী অভিশ্রুতি শাস্ত্রী ছিলো পুরোপুরি উল্টো স্বভাবের। সে ছিলো অকৃতজ্ঞ সত্তা। সে বর্তমান বাবা-মায়ের দত্তক নেয়া সন্তান, ওকে যারা চিনতাম-জানতাম, তারা এমনটাই ধারণা করতাম। যদিও ওর বাবা-মা ঢাকার কোনো সাংবাদিকের কাছে কখনোই স্বীকার করেননি, অভিশ্রুতি তাদের দত্তক নেয়া। তারা মাতৃত্ব-পিতৃত্বের দৃঢ়তার সঙ্গে বলতেন, অভিশ্রুতি তাদের জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) সন্তান। তবুও তেমনটা ধারণা করার কারণ, অভিশ্রুতি থেকে আমাদের জানা দত্তক ‘কাহিনি’। সে জানায়, ভারতের একটা রাজ্যের সনাতন ধর্মাবলম্বী কোনো পরিবারে ওর জন্ম, ওদের পারিবারিক বংশীয় উপাধি ব্রাহ্মণ (এ কারণে সে নামের সঙ্গে ‘শাস্ত্রী’ যোগ করে, শাস্ত্রী ব্রাক্ষণদের পদবি)। মুসলমান পরিবারে বেড়ে ওঠলেও জন্মগতভাবে ‘হিন্দু’ হওয়ায় সে ঢাকায় এসে সনাতন ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়ায়।
অভিশ্রুতি জৈবিক, না দত্তক, এ বিতর্কের অবসান ঘটাতে প্রশাসন ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নিলে ওর বাবা-মা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রাজি হন। তা দেখে অনেকে বলছেন, সে তাদের জৈবিক সন্তান। তর্কের খাতিরে ধরে নিই, ঢাকার বেইলি রোডের আগুনে নিহত অভিশ্রুতি বাবা-মায়ের দত্তক নেয়া। তারা ওকে লালনপালন করেছেন, স্নেহ-মমতা দিয়েছেন। তাদের প্রতি এজন্যেও ওর কৃতজ্ঞতা বোধে ঘাটতি ছিলো। ওর বাবা-মা ইসলামের নিষ্পাপ বিশ্বাসী, জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত নন। ইসলামে বিশ্বাসী হওয়ায় অভিশ্রুতি তাদেরকে উগ্র মনে করতো। ইসলামে বিশ্বাসী মানেই কেউ উগ্র নন, উগ্রতা ভিন্ন বিষয়। সে হিন্দু হতে চেয়েছিলো। সনাতন ধর্ম পৃথিবীতে বহুমত, সহাবস্থান প্রতিষ্ঠিত করে। বাইবেলের কথা একটু ঘুরিয়ে বললে, ‘ধর্ম মানুষকে আলোকিত করে’। হয়তো বয়স কম হওয়ায় অভিশ্রুতির ভেতরে প্রকৃত ধর্মবোধ জন্মায়নি।
অভিশ্রুতি বাবা-মায়ের কোন ধরনের সন্তান, তা প্রমাণ হবে পরীক্ষায়। যদি দত্তকই হয়, ওর বাবা-মা এতো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ডিএনএ পরীক্ষায় কেন রাজি হলেন, সেটাও প্রশ্ন। ওর ইউরোপে চলে যাওয়ার স্বপ্ন ছিলো। তাহলে কি মুসলমান পরিবারে বেড়ে ওঠেও হিন্দু হওয়ার চেষ্টা, ইউরোপের ভিসা পাওয়ার সুবিধায়? সব দম্পতির সন্তান জন্মায় না। মাতৃত্ব-পিতৃত্বের হাহাকার তারা মেটাতে দত্তক নেন। দত্তকরা বড় হয়ে পছন্দমতো ধর্ম বেছে নিক। তবে তারা অকৃতজ্ঞতায় অভিশ্রুতি না হোক। ওর মতো আর একটা প্রাণও যেন মর্মস্পর্শী মৃত্যুর শিকার না হয়, সেদিকে রাষ্ট্রের নজর দেয়া জরুরি। বিশ্বাসের ভুবনে সে ভালো থাকুক।
লেখক: হাসান শান্তনু, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম গবেষক।