সব ব্যাপারেই এতো নাক গলানোর মানে হয় না, প্রসঙ্গ যৌথ বিবৃতি

:: পথিক হাসান ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে ১৩টি বিদেশি মিশনের যৌথ বিবৃতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকার। বুধবার (২৬ জুলাই) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় কূটনীতিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। পরে বিকালে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, “আমরা আমাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছি। আমি আশা করি তারা উপলব্ধি করবে যে তাদের যৌথ বিবৃতিটি সময়ের আগেই উপস্থাপন করা হয়েছে, ঘটনা প্রবাহের সাথে ধাপে ধাপে বাইরে, এবং তারা ভবিষ্যতে এই ধরনের অকূটনৈতিক আচরণ থেকে বিরত থাকবে।”

তিনি বলেন, তারা কূটনীতিকদের ভিয়েনা কনভেনশনের কথা মনে করিয়ে গঠনমূলক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

শাহরিয়ার আলম বলেন, কূটনীতিকদের সতর্ক করা হয়েছে যে সরকারকে এড়িয়ে যাওয়া এবং “বস্তুত্বহীনতা, নিরপেক্ষতা এবং নিরপেক্ষতা বর্জিত” আচরণ করা শুধুমাত্র পারস্পরিক আস্থার সংকট তৈরি করবে।

ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনে একজন প্রার্থী লাঞ্ছিত হওয়ার পর সম্প্রতি যৌথ বিবৃতি জারি করা ১৩টি বিদেশি মিশনের রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

যৌথ বিবৃতিতে কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের দূতাবাস/হাইকমিশন স্বাক্ষর করেছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি ১৩ রাষ্ট্রদূতদের গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে নেয়া ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ ইস্যুটি মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের সামনে তুলে ধরেন একজন সাংবাদিক। জবাবে প্যাটেল বলেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র একত্রে কাজ করছে। আমরা সব সময়ই এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছি। এটা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

ওই সাংবাদিক বেদান্ত প্যাটেলের কাছে জানতে চান- আমি যদি বাংলাদেশের মিডিয়ার রিপোর্টগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সহ মোট ১৩টি বিদেশি মিশনের প্রধানরা। এ জন্য তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব (সমন) করা হয়। এরও আগে ২০শে জুলাই আবাসিক সমন্বয়ককে তলব করা হয়। আপনারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানাচ্ছেন। পশ্চিমা মিত্ররা এবং উন্নয়নে অংশীদাররাও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করছে। কিন্তু সরকার চলছে অন্যপথে। তারা ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের তলব করছে। এর প্রেক্ষিতে আপনার মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া কি?

এ প্রশ্নের জবাবে বেদান্ত প্যাটেল বলেন, আমরা পরিষ্কার করে বলেছি- গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো স্থান নেই। আমরা আরও পরিষ্কার করেছি যে, কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জন সমর্থন করি আমরা। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করার ওপর সব সময়ই গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা বিশ্বাস করি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন একটি অভিন্ন অগ্রাধিকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ বাংলাদেশ সরকারের অনেক কর্মকর্তা নিজেরাই বলেছেন, এটা তাদেরও লক্ষ্য। ঠিক আছে। তো সব ব্যাপারেই এত নাক গলানোর মানে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের কাজই শুধু মাতব্বরি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বাংলাদেশি হত্যা: যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে এবং প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনার খালি বাণী দিচ্ছেন, তাতে বাংলাদেশ আর কতদিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের শিকার হবে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত সংবাদপত্রে পড়ি বন্দুকধারীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন’-এর গালভরা উপাখ্যান পরে হামলা চালাচ্ছে। নিউজ এজেন্সি এপি, ইউএসএ টুডে এবং বোস্টনের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির যৌথ গবেষণা-আর্কাইভ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৮টি বন্দুক হামলা হয়েছে এবং ১৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। অন্যদের নিয়ে চিন্তা না করে নিজের অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সময় এসেছে

গত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন বনানীতে একটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে আশরাফুল আলম (হিরো আলম) নামে এক প্রার্থীকে মারধর করেছে কয়েকজন। এটি একটি জঘন্য অপরাধ এবং অবশ্যই আমরা এর নিন্দা জানাই। কোনো নির্বাচনী প্রার্থী এমনকি সাধারণ ভোটারকেও কেউ আক্রমণ করতে পারবে না। আমরা জানি হামলাকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তার ওপর হামলার কারণ কী? এই হামলার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা জরুরি। শুধু হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনলেই হবে না, এর উসকানিতে জড়িতদেরও শাস্তি হওয়া উচিত। যেভাবেই হোক, বাংলাদেশের প্রতিটি যোগ্য নাগরিক, তাদের রাজনৈতিক সখ্য বা সামাজিক প্রেক্ষাপট নির্বিশেষে, নির্ভয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকার থাকা উচিত। আর তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।

দেশে প্রয়োজনীয় আইন আছে। সেই আইন অনুযায়ী দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সরকার এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন নয়। কিন্তু ওই ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের বিবৃতি অবশ্যই কূটনৈতিক রীতিনীতির লঙ্ঘন। এবং তারা একটি গ্রুপে বিবৃতি দিয়েছেন। একজন সাংবাদিক এটাকে ১২-দলীয় জোট হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ঠিক যেমন আমাদের দেশে বা প্রতিবেশী ভারতে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচন বা রাজনৈতিক কর্মসূচি উপলক্ষে জোট গঠন করে। আমি জানি না অন্যান্য দেশেও বিদেশী দূতাবাসের এই ধরনের জোট গঠনের ইতিহাস আছে কিনা। যদি তা না হয়, তাহলে তারা কেন পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলঙ্কায় নয়, বাংলাদেশে তা করছে? এটা কি অন্য কারণে বাংলাদেশকে চাপ দেওয়ার কিছু? কিছু বিশ্লেষক বলছেন, তারা বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে চাপ দিচ্ছেন। তারা সহজেই দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীন ও রাশিয়ার ব্যস্ততা দেখতে পায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং চীনের গতিবিধি তাদের বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা নিয়ে চিন্তিত হতে পারে, যদিও সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও আরও কয়েকজন মন্ত্রী এই বক্তব্য নিয়ে কথা বলেছেন। বিবৃতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন তোলেন- যখন তাদের দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়, সেখানে অবস্থানরত কূটনীতিকরা কি কোনো বক্তব্য দেন? তিনি গণমাধ্যমকে আরও বলেন, এ ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি বন্ধ করার সময় এসেছে।

আমি ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ-৪১.১ উদ্ধৃত করতে চাই যেটি বলে, “তাদের বিশেষাধিকার এবং অনাক্রম্যতার প্রতি কুসংস্কার ছাড়াই, এই ধরনের বিশেষাধিকার এবং অনাক্রম্যতা উপভোগ করা সমস্ত ব্যক্তির কর্তব্য গ্রহনকারী রাষ্ট্রগুলির আইন ও প্রবিধানকে সম্মান করা৷ সেই রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করাও তাদের কর্তব্য।” বাংলাদেশে কর্মরত রাষ্ট্রদূতেরা ভিয়েনা কনভেনশনে উল্লিখিত সুযোগ-সুবিধা ও অনাক্রম্যতা পুরোপুরি ভোগ করলেও কি কারণে তারা অনুচ্ছেদ-৪১ লঙ্ঘন করছেন? তারা কি মনে করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের ইচ্ছামত হস্তক্ষেপ করতে পারে? বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভিয়েনা কনভেনশনের সূচনায় বলা হয়েছে যে কূটনৈতিক মিলন, সুযোগ-সুবিধা এবং অনাক্রম্যতা সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন বিভিন্ন সাংবিধানিক ও সামাজিক ব্যবস্থা নির্বিশেষে দেশগুলির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিকাশে অবদান রাখবে। তারা যদি তাদের দায়িত্বে মনোনিবেশ করেন, তাহলে তাদের পাশাপাশি এদেশের মানুষের জন্য মঙ্গল হবে।

বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের প্রথম কাজ হলো তাদের দেশের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং উন্নত করা। এক্ষেত্রে পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও সমর্থনকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের যেমন এদেশের মানুষ ও রাজনীতি বুঝতে হবে, তেমনি এদেশের সমাজব্যবস্থাও জানতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে যে তারা ভিন্ন রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশ থেকে এসেছে। দুই দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয় এমন কিছু করা তাদের জন্য সঙ্গত হবে না। তারা আমাদের উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে অবদান রাখতে তাদের পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে আসলে দোষের কিছু নেই। যাইহোক, এটি একটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে করা উচিত, কোন দক্ষতাপূর্ণ মনোভাব সঙ্গে না.

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে সবসময়ই কিছু অতি উৎসাহী মানুষ বা কর্মী থাকে। তারা সব সময় এমন অনাকাঙ্খিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে যা শেষ পর্যন্ত দলেরই ক্ষতি করে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ব্যাপারে সতর্ক না হলে তাদের মূল্য দিতে হবে। রাজনীতিতে সহনশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দর্শনে ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। এ কারণে দেশে অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে। কিন্তু দেশপ্রেমের ব্যাপারে সবার একটা অভিন্ন দর্শন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপস কখনোই দেশের মঙ্গল বয়ে আনবে না। তা না হলে বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো বন্ধ করবে না।

 

লেখক: পথিক হাসান; নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিষয়ক বিশ্লেষক।