সকল শিক্ষার মূল আদব বা শিষ্টাচার

:: মোহাম্মদ রেজাউল মোস্তফা ইব্রাহিম ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে
মোহাম্মদ রেজাউল মোস্তফা ইব্রাহিম

ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো আদব বা শিষ্টাচার। মানুষের হৃদয় জয় করার অন্যতম মাধ্যম এটি। আর এর মাধ্যমেই সারা পৃথিবীতে ইসলাম বিজয় লাভ করেছে। এ আদব বা শিষ্টাচারকে সহজভাবে বলা যায় ভদ্রতা। ইসলামে ভদ্রতার মর্যাদা ও গুরুত্ব অত্যাধিক।

আল্লাহ তায়ালা পরস্পরের সঙ্গে ভদ্রতা বা শিষ্টাচার প্রকাশে সালামের বিধান দিয়েছেন। এ কারণেই মুমিন মুসলমান পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাত হলেই প্রথমে অভিবাদন প্রদান ও দোয়া স্বরূপ সালাম প্রদান করেন। আর এ সালামের উত্তর আরও উত্তমভাবে দেয়ার জন্য পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-

‘যখন তোমরা সালাম ও অভিবাদনপ্রাপ্ত হও, তখন তোমরা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর সম্ভাষণ কর অথবা একইভাবে অভিবাদন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী’ (সূরা নিসা-৮৬)।

শিষ্টাচারের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুওতের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ’ (আবু দাউদ-৪৭৭৬)।

হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তুমি আদব অন্বেষণ কর। কারণ আদব হলো বুদ্ধির পরিপূরক, ব্যক্তিত্বের দলিল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ সহচর, প্রবাস জীবনের সঙ্গী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ’ (ইছবাহানি, মুনতাখাব; সাফারিইনি, গিযাউল আলবাব, ১/৩৬-৩৭)।

হজরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তোমরা আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন কর।’

বিশিষ্ট ফকিহ আহনাফ আল-কায়েস বলেন, ‘আদব বা শিষ্টাচার বিবেকের জ্যোতি, যেমন আগুন দৃষ্টিশক্তির জ্যোতি’ (ফাতাওয়া আল মিসরিয়া- ১০/৩৫৯)।

কোন মুসলিম কাঙ্ক্ষিত মানের ও সুসভ্য মানুষ রূপে গড়ে উঠবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতি অপেক্ষা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করতে সক্ষম হবে তখনই, যখন ইসলামি শিষ্টাচারের সুষমাকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পার্থিব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে ফুটিয়ে তুলতে পারবে।

শিষ্টাচার হচ্ছে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণ। শিষ্টাচার মানুষকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে। শিষ্টাচারের বীজ মূলত বপিত হয় শিশুকালে। আর এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা প্রধান। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। পরিবারের বড়রা যে রকম ব্যবহার করে শিশুরা তাই অনুকরণ করে। বাল্যকালে শিশুদের সংযম, বিনয় ও উন্নত রুচির চর্চা ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে শিষ্টাচার গড়ে তোলে।

সমাজ জীবনের ভারসাম্য, শৃঙ্খলা, উন্নতি ও অগ্রসরতা অব্যাহত রাখতে পারস্পরিক সৌজন্যতা, মূল্যবোধ ও শিষ্টাচারের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো জাতিকে সুসভ্য ও সফল রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে এর বিকল্প নেই। আমাদের বিদ্যমান অশান্ত সমাজে শান্তি ও স্থিতি আনতে হলে সবাইকে শিষ্টাচারসম্পন্ন হতে হবে। কারণ শিষ্টাচারসম্পন্ন মানুষ কোনো তুচ্ছ বিষয়ে নিজেকে জড়ায় না, কারও সঙ্গে শত্রুতা করে না বা কারও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করে না। শিষ্টাচার হচ্ছে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণ। একজন মানুষ ভালো না মন্দ তা বিবেচিত হয় মূলত সে ব্যক্তির আচরণ দেখেই। এ গুণ মানুষকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে। শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তি তার ভদ্র ও সংযত ব্যবহার দিয়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। এমন মানুষকে সবাই শ্রদ্ধা করে; হোক সে ব্যক্তি অসুন্দর কিংবা গরিব। ইসলামেও আদব, শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন।

পৃথিবীতে যারা মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, তারা শিষ্টাচার ও মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। প্রত্যেক ধর্মে আদব ও শিষ্টাচারের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন শিষ্টাচারের মূর্তপ্রতীক। উন্নত ব্যবহারের জন্য তিনি ছোট-বড় সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। সংযম, বিনয়, ভদ্রতা তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কখনও তিনি কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি, উদ্ধত আচরণ করেননি। এ কারণেই যুগে যুগে মানুষের কাছে তিনি এত শ্রদ্ধার পাত্র। তবে এ গুণ হঠাৎ করে কারও মধ্যে গড়ে ওঠে না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব।

সালাম বা সম্ভাষণ: ইসলামে পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্ভবপর মুছাফাহা করা এবং কুশল বিনিময় করা যায়। মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দেয়, আল্লাহর নিকট লোকদের মধ্যে সেই উত্তম’।

সবার সাথে উত্তম ব্যবহার: জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার সাথে সুন্দর আচরণ করা ও ভাল কথা বলা, ভদ্র ও মার্জিত রুচির পরিচায়ক। সদাচরণ মানুষকে কাছে টানে। সদাচরণের বাস্তব উদাহরণ ছিলেন প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা, ‘আর আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছেন। যদি আপনি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত’ (আল ইমরান-৩/১৫৯)।

সুন্দর কথা বলা: অসুন্দর কথা ও খারাপ ভাষা প্রয়োগ করে কোন আদর্শ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীতে যত আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সুন্দর কথা দিয়েই হয়েছে। ভাল কথা দিয়ে সহজেই মানুষের মন জয় করা যায়। শ্রেষ্ঠ মনীষীরা সুভাষী ছিলেন।

পাপ ও হারাম কথা থেকে জিহবাকে সংযত রাখা: কথাবার্তায় জিহবাকে সংযত ও নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কেননা কোন গোনাহের কথা বা হারাম কথা বললে তার জন্য পরকালে শাস্তি পেতে হবে। মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কোন বান্দার ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক হবে না যতক্ষণ না তার অন্তর সঠিক হবে। আর অন্তর ঠিক হবে না যতক্ষণ না তার জিহবা ঠিক হবে’।

অন্যের আমানত রক্ষা করা: কোন ব্যক্তি কোন কথা আমানত হিসেবে বললে তা রক্ষা করা মুমিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য। মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যার আমানতদারী নেই, তার ঈমান নেই’। অন্যের বলা কথার গোপনীয়তা রক্ষা করা জরুরি। সে ব্যক্তি মুখে গোপনীয়তা রক্ষার কথা না বললেও যখন সে ঐ কথা অন্যের সামনে বলতে চাইবে না কিংবা অন্য কেউ শুনুক সেটাও পছন্দ করবে না, তখন বুঝে নিতে হবে যে, সেটা গোপনীয় কথা-যা গোপন রাখাই জরুরি। মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোন ব্যক্তি কোন কথা বলার পর মুখ ঘুরালে (কেউ শুনছে কি-না তা দেখলে) তা আমানতস্বরূপ’।

মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলা: কথা বলার ক্ষেত্রে মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলা উচিত। দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলা সমীচীন নয়। কারণ এতে মানুষ কথা বুঝতে না পেরে কষ্ট পায়। হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘মানুষের নিকট সেই ধরনের কথা বল, যা তারা বুঝতে পারে। তোমরা কি পছন্দ কর যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হোক?’

তিনজন থাকলে দু’জনে কানে কানে কথা না বলা: কোথাও তিনজন লোক থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে দু’জনে কানে কানে কথা বলা যাবে না। কারণ এতে তৃতীয় ব্যক্তি মনে কষ্ট পায়। মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তিনজন একত্র হলে একজনকে বাদ দিয়ে যেন দু’জনে কানে কানে কথা না বলে। কেননা তাতে সে চিন্তিত হতে পারে’।

ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও কাউকে হেয় করার মানসিকতা ত্যাগ করা: কাউকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা এবং হেয় করার চিন্তা মন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! কোন সম্প্রদায় যেন কোন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। হতে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। আর নারীরা যেন নারীদের উপহাস না করে। হতে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। তোমরা পরস্পরের দোষ বর্ণনা কর না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। বস্ত্ততঃ ঈমান আনার পর তাকে মন্দ নামে ডাকা হলো ফাসেকী কাজ। যারা এ থেকে তওবা করে না, তারা সীমালংঘনকারী’ (হুজুরাত-৪৯/১১)।

একাই কথা বলার মানসিকতা পরিহার করা: অনেকে আছেন কেবল নিজেই অধিক কথা বলতে বেশি ঞ পছন্দ করেন। অন্যকে কথা বলার সুযোগ কম দেন। এরূপ মানসিকতা পরিহার করা আবশ্যক। বরং অন্যের কথা শুনতে হবে ও তাদেরকে বলার সুযোগ দিতে হবে। আর কোন মজলিসে কথা বলার ক্ষেত্রে বয়জ্যেষ্ঠকে প্রাধান্য দিতে হবে।

মনোযোগ সহকারে কথা শ্রবণ করা: বক্তার কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা উচিত। কারো কথা শ্রবণ না করে তাকে হেয় করা, তার থেকে নিজেকে অধিক পন্ডিত যাহির করার চেষ্টা করা কিংবা তাকে অযথা মিথ্যুক সাব্যস্ত করা যাবে না। বরং তার কথা শ্রবণ করে সেটা যাচাই করার প্রয়োজন হ’লে তা করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

দৈনন্দিন জীবনে শিষ্টাচার: প্রতিটি ক্ষেত্রে আদব বা শিষ্টাচার অনুযায়ী চলতে হয়। শৃঙ্খলা অনুসারে চললে সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকে। নির্দেশনা অনুসারে কাজ করা না হলে সে কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় না এবং তাতে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। শিষ্টাচারের সর্বোত্তম উদাহরণ হলেন প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

দৈনন্দিন কর্মকান্ড: বিকট আওয়াজে অট্টহাসি হাসা, চিৎকার ও হৈ হুল্লোড় ইত্যাদি করা কোন শালীন মানুষের কাজ নয়। পক্ষান্তরে মৃদু বা মুচকি হাসি অপরের মনে বিরক্তির উদ্রেক করে না। বরং আনন্দ দেয় ও ভালোবাসা পয়দা করে। হজরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, ‘আমি -কে অট্টহাসি করতে দেখিনি, যাতে তাঁর জিহবার তালু দেখা যায়। তিনি মৃদু হাসতেন’।

অফিস-আদালতে শিষ্টাচার: অফিস-আদালতে কর্তাব্যক্তি যদি তার অধঃস্তনের সাথে উত্তম ব্যবহার করে তাহলে অধীনস্থরা প্রাণ খুলে আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য দোআ করে। সবাই মিলেমিশে প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য কাজ করতে পারে। প্রতিষ্ঠানও তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়।

পরিপাটি থাকা: ইসলাম মানুষকে সদা পরিপাটি থাকতে শিখায়। আতা বিন ইয়াসার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে অবস্থানকালে একটি লোক মাথা ও দাড়ির কেশ অবিন্যস্ত অবস্থায় সেখানে প্রবেশ করল। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত দ্বারা তার দিকে ইশারা করলেন যেন সে তার মাথা ও দাড়ির কেশ বিন্যাস করে। সে ব্যক্তি তা করে ফিরে এলো। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, শয়তানের মতো তোমাদের কোন ব্যক্তির এলোকেশে আসার চেয়ে এটা কি উত্তম নয়?

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা: পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা শিষ্টাচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (আল বাকারাহ-২/২২২)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘সেখানে এমন সব লোক রয়েছে, যারা উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হওয়াকে ভালোবাসে। বস্ত্তত: আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (আত তওবা-৯/১০৮)।

লজ্জাশীলতা: লজ্জাশীলতা সভ্যতা ও মার্জিত রুচির পরিচায়ক। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন লজ্জাশীলতার মূর্ত প্রতীক। তিনি বলেন, ‘লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ’।

প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা: প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ ও ভাল ব্যবহার করা একজন মুসলমানের অন্যতম কর্তব্য। সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা ও সদ্ভাব বজায় রাখা অপরিহার্য। প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি এটা পছন্দ করে যে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তাকে ভালোবাসুক, সে যেন কথা বললে সত্য বলে, আমানত রাখা হলে তা পূর্ণ করে এবং স্বীয় প্রতিবেশীর সাথে ভাল ব্যবহার করে’।

উপহার-উপঢৌকন: হাদিয়া বা উপহার আদান-প্রদান করা শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত। এতে পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি-সদ্ভাব গড়ে ওঠে। মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা একে অপরকে উপঢৌকন দাও এবং ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হও’।

পারস্পরিক দোষ-ত্রুটি সংশোধন করে দেওয়া: কারোর মধ্যে দোষ-ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে সংশোধনের উদ্দেশ্যে তাকে ব্যক্তিগতভাবে বলতে হবে। যাতে সে সংশোধন হয়ে যায়। প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়না স্বরূপ। এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। তারা একে অপরকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে’।

কু-ধারণা না করা: দয়াময় মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক। কেননা কোন কোন ধারণা পাপ’ (আল হুজুরাত-৪৯/১২)। প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা অনুমান করা থেকে সাবধান হও। কেননা অনুমান অবশ্যই সর্বাপেক্ষা বড় মিথ্যা। আর তোমরা অন্যের দোষ অন্বেষণ করো না, গুপ্তচরবৃত্তি করো না, পরস্পরের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করো না এবং পরস্পরের সাথে হিংসা করো না। পরস্পরের ক্ষতি করার জন্য পেছনে লেগে থেকো না। আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও’।

সবার জন্য কল্যাণ কামনা করা: এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য কল্যাণ কামনা করবে। দয়াময় মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব, তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে’ (আল ইমরান-৩/১১০)। এখানে একজন মুসলমানকে সকল মানুষের কল্যাণ কামনার জন্য বলা হয়েছে।

একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা: এক মুসলিম অপর মুসলিম ভাইকে সাধ্যমত সহযাগিতা করবে এটা ইসলামের শিক্ষা। এর ফলে সে আল্লাহর সাহায্যের হকদার হয়ে যাবে। প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে নিয়োজিত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণে ব্যস্ত থাকেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের একটি সমস্যা দূর করবে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার সমস্যাগুলির একটি সমস্যা দূর করে দিবেন’। তিনি আরো বলেন, ‘তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে অত্যাচারী হোক অথবা অত্যাচারিত হোক’। অর্থাৎ প্রতিবেশী যদি অত্যাচারী হয় তবে তাকে অত্যাচার থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে সাহায্য করতে হবে।

কোরআনের আলোকে শিষ্টাচার: শিষ্টাচারের বিভিন্ন দিক পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। শিষ্টাচারের শিক্ষা দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি ক্ষমার নীতি গ্রহণ কর। লোকদের সৎকাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল’ (আল আরাফ-৭/১৯৯)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ আরো বলেন, ‘ভাল ও মন্দ কখনো সমান হ’তে পারে না। তুমি উত্তম দ্বারা (অনুত্তমকে) প্রতিহত কর। ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে যেন (তোমার) অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হতে পারে, যারা ধৈর্যধারণ করে এবং এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হতে পারে, যারা মহা ভাগ্যবান’ (ফুছছিলাত/হামিম সাজদাহ-৪১/৩৪-৩৫)।

হাদিসের আলোকে শিষ্টাচার: ইসলাম মানুষকে সর্বোত্তম আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছে। প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি’। হজরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, ‘তাঁর চরিত্র হলো আল কোরআন’। প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম, যাদের চরিত্র উত্তম’। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে আমার নিকটে সর্বাধিক প্রিয় সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র উত্তম’। তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের যে ব্যক্তির চরিত্র ও আচরণ সর্বোত্তম, তোমাদের মধ্যে সে-ই আমার নিকটে সর্বাধিক প্রিয় এবং কিয়ামত দিবসেও আমার খুবই নিকটে থাকবে’।

মুসলমানের পরিচয়: সেই পূর্ণ মুসলমান যার আচরণ সর্বোত্তম। যে ব্যক্তি লেনদেন ও কাজ-কারবারে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত, ওয়াদা পূর্ণ করে ও দায়িত্ব পালন করে; মানুষকে ধোঁকা দেয় না, আমানতের খেয়ানত করে না, মানুষের হক নষ্ট করে না, ওজনে কম দেয় না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং সুদ-ঘুষসহ যাবতীয় অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকে, সেই প্রকৃত মুসলমান। খাঁটি মুসলিম সেই ব্যক্তি যার জিহবা ও হাত থেকে অপর মানুষ নিরাপদে থাকে। কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্যে যা পছন্দ করে তার ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করবে।

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আদব বা ভদ্রতা মেনে নিজেকে পরিচালনা করা। সুন্দর সমাজ গঠনে সবার সঙ্গে উত্তম আচরণের মাধ্যমে শিষ্টাচার বজায় রাখা। সবার সঙ্গে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। কেননা উত্তম আদব বা শিষ্টাচার বজায় রাখায় রয়েছে প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর জীবনের অনুকরণীয় আদর্শ। জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও অনুকরণ করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, যানবাহনে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবার সাথে ভাল ব্যবহার করা। কথাবার্তায় ইসলামি আদব বা শিষ্টাচার মেনে চলা। এর মাধ্যমে ইহকালে মানুষের ভালাবাসা ও শ্রদ্ধা লাভ করা যাবে এবং পরকালীন জীবনে অশেষ সওয়াব হাছিল করা যাবে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর আদর্শ মোতাবেক শিষ্টাচার তথা উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

 

লেখক: মোহাম্মদ রেজাউল মোস্তফা ইব্রাহিম; লেখক, কলামিস্ট, ইসলামি গবেষক।