পথে বসেছে লঞ্চ ব্যবসা

:: পা.রি. রিপোর্ট ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

বরিশাল বিভাগের জন‌্য এক ধরনের গলার কাঁটা ছিল পদ্মা নদী। শতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে এই নদীর ভয়াল ইতিহাসের ছাপ পড়েছিল এপারের মানুষের জীবনযাত্রায়। কিন্তু অভিশপ্ত সেই জীবনের গল্প আজ অতীত। সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সক্ষমতায় কীর্তিনাশা জয়ের ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছে।

২০২২ সালের আজকের দিনে (২৫ জুন) চালু হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলবাসীর বহুল কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু। এরপর মাত্র ৩৬৫ দিন পার হয়েছে, ইতোমধ্যে বদলাতে শুরু করেছে চির অবহেলিত বাংলার শস্যভাণ্ডার বরিশাল।

পর্যটন, অর্থনীতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট, চিকিৎসা, যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসাখাতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। জনপদ ভিত্তিক উন্নয়নে অভাবনীয় গতি ফিরেছে। এখন আর মোটা দাগে পদ্মার এপার-ওপার বলে বিভাজন করতে পারে না। যদিও আকাঙ্ক্ষিত সেতুটি চালুর পরপরই মন্দায় পড়েছে লঞ্চ ব‌্যবসায়ীরা। বন্ধ হয়ে গেছে অভ‌্যন্তরীণ সিংহভাগ রুট। ঢাকা-বরিশাল নৌরুটও ধুঁকছে যাত্রী সংকটে। অর্থাৎ স্থলভাগে জমজমাট হয়ে উঠছে জীবনযাত্রা, বিপরীতে নৌপথে ব্যবসা বিধ্বস্ত। আবার সড়কে গাড়ির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে, সেই সঙ্গে প্রাণহানিও।

১৩ হাজার ২২৫ বর্গকিলোমিটার নদীবেষ্টিত ছয়টি জেলা নিয়ে ১৯৯৩ সালে বরিশাল বিভাগ গঠিত হয়। ২০১১ সালের আদমশুমারি বলছে এই জনপদের মোট জনসংখ্যা ৮৩ লাখ ২৫ হাজার ৬৬৬ জন। আদমশুমারির পরবর্তী ১২ বছরে তা আরও বেড়েছে। এই বিভাগে পর্যটনের জন্য যেমন রয়েছে অপার সম্ভাবনা তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও রয়েছে অনেক সুযোগ। কিন্তু যুগ যুগ ধরে তার বিকাশ হয়নি নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন‌্য। মূলত রাজধানীর সঙ্গে যাতায়াতে পদ্মা নদী পার হওয়া ছিল ভোগান্তি আর বিড়ম্বনার। তেমনি লঞ্চে যোগাযোগ ছিল দীর্ঘ সময় অপচয়। আগে দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় পণ্য পৌঁছাতে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগত। সেখানে এখন ৩ থেকে ৫ ঘণ্টায় পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে। আর যাতায়াতে সর্বোচ্চ ৫ ঘণ্টা সময় লাগে যেকোনো জেলা থেকে।

বরিশাল পোর্ট রোডের ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন বলেন, লঞ্চে পণ্য পরিবহনে খরচ কিছুটা কম হলেও সড়কপথে এখন দ্রুত সময়ের মধ‌্যে নিরাপদে মালামাল পৌঁছে দিতে পারছি। এতে আমাদের ব্যবসার গতি বেড়েছে।

বাজার রোডের শ্রমিক শামীম বলেন, পদ্মা সেতু চালু আগে ট্রাকের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হত। এখন সারাদিন মালামাল লোড আনলোড করেই দিন পার হয়ে যায়। আগে দিনে ৫০০ টাকা আয় হলেও এখন ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত হয়। শ্রমিক হিসেবে আমার উপকার হয়েছে, যারা বড় ব্যবসায়ী তাদেরও গতি এসেছে।

বরিশাল শিল্প নগরীর শিল্প উদ্যোক্তা সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, আমরা যারা চিটাগং পোর্টের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের কাছে পদ্ম সেতু আশীর্বাদ। আমার কোম্পানির উৎপাদিত সকল জুতাই দেশের বাইরে রপ্তানি হয়। যা চিটাগং পোর্টের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। বরিশাল থেকে একটি কাভার্ডভ্যান কিংবা ট্রাক পোর্টে গিয়ে পৌঁছাতে কমপক্ষে তিন দিন সময় লাগতো। কোনো ক্ষেত্রে ৬-৭ দিনও লেগে যেত। এখান এক দিনের মধ্যে বরিশাল থেকে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে পরিবহন খরচ অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এই ব্যয় শুধু আমাদের বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, ছোট-মাঝারি সকল শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য কমেছে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে সড়কপথে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। একের পর এক বিলাসবহুল বাস সার্ভিস যুক্ত হচ্ছে। সোহাগ ক্ল্যাসিক, গ্রিনলাইন, ইউরো কোচ, শ্যামলী, এনআর ট্রাভেলস, সাকুরা, ইলিশ, প্রচেষ্টা, এনা, সুপার সনি, গ্রিন সেন্ট মার্টিন, ইউনিক পরিবহনের মতো নামকরা পরিবহনগুলো যুক্ত হওয়ায় স্বাচ্ছন্দ্যে আরামের ভ্রমণ দিচ্ছে যাত্রীদের।

সাকুরা পরিবহনের বরিশাল কাউন্টার ম্যানেজার আনিসুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে দিনে দুটি বাস চলাচল করত বরিশাল থেকে। পদ্মা সেতু চালুর পর এই টার্মিনাল থেকে ১০/১২টি গাড়ি চলাচল করছে। এভাবে সবগুলো জেলায় চাহিদা বেড়েছে।

শুধু সড়কে নয় দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়নের দুয়ার খুলে দিয়েছে পদ্মা সেতু। সরকারি ব্রজমোহন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. আখতারুজ্জামান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে নীরব প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আরও বলেন, সেতু চালু হওয়ার পর দেশে মোট শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার এক শতাংশ বাড়বে দক্ষিণাঞ্চলে। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন সেতু চালু হওয়ার পর গতি বাড়লেও কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের জন‌্য দক্ষিণাঞ্চলে মাস্টারপ্ল্যান দরকার।

বরিশাল বিশ্ববিদ‌্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রিফাত ফেরদৌস মনে করেন, দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়ন ও সড়কপথে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। ব‌্যবসায়ীরা কোন কোন ক্ষেত্রে মুনাফা খাটাবে সে বিষয়ে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি দুটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। সরকার পরবর্তী পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় এ বিষয়ে বিবেচনা করে দেখবেন বলে আমি আশা করি।

বরিশাল চেম্বার অব কমার্স সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়েছে। আমাদের এখন শুধু গ্যাস দরকার হবে। আর বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান এখনও খুলনা নির্ভর। সেগুলোর আঞ্চলিক কার্যালয় সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।

তবে পদ্মা সেতু চালুর পর সড়কে গাড়ির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে, সেই সঙ্গে প্রাণহানিও। এ বিষয়ে বরিশাল ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিগত দশ মাস আমি বরিশালের দায়িত্বে রয়েছি। আগের বছরের তুলনায় সর্বশেষ দশ মাসের হিসাব পর্যালোচনা করলে সড়কে দুর্ঘটনার সংখ‌্যা বেড়েছে। এজন্য তিনটি কারণ দায়ী। প্রথমত চালকদের অদক্ষতা, দ্বিতীয়ত যান্ত্রিক ত্রুটি এবং তৃতীয়ত বরিশাল বিভাগের সরু সড়ক। ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে পর্যন্ত যে গতিতে গাড়িগুলো আসে তারপরই সরু সড়কে প্রবেশ করে। ফলে গাড়ির চাপ ও অপ্রশস্ত সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ।

 

পথে বসেছে লঞ্চ ব্যবসা
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে বরিশাল বিভাগের ১২টি নৌ-রুটে। লঞ্চ চলাচলের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় রুট ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রী সংকটের মধ্যে রয়েছে বরগুনা-পটুয়াখালীর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ রুটগুলো। এমনকি বরিশাল নদীবন্দরেও যাত্রীর খরা। লঞ্চ মালিকরা রোটেশন ব্যবস্থা চালু করে নিজেদের টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালেও যাত্রী ফেরাতে পারছেন না। সামনের ঈদেও কত সংখ্যক যাত্রী পাবেন তা নিয়ে শঙ্কা কাটছে না।

বিআইডব্লিউটিএ বলছে, ঢাকা-বরিশাল নৌরুট এবং অভ্যন্তরীণ ১১টি রুটের মধ্যে ভান্ডারিয়া, টরকি, ঝালকাঠি এবং বরগুনা রুট যাত্রীর অভাবে সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালীর ৬টি রুটের মধ্যে ৫টিই বন্ধ হয়ে গেছে। পটুয়াখালী থেকে দিনে একটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেলেও যাত্রীর সংকটে ঈদুল আজহার পরে সেটিও বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বরগুনা থেকেও মাত্র একটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ে। সেখানেও যাত্রী সংকটে প্রতিদিনের খরচ উঠছে না। রোটেশন ব্যবস্থা চালু করে চারদিন পর একটি লঞ্চ ট্রিপ পায়।

ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী এমভি সুরভী লঞ্চের পরিচালক রেজিন-উল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় সব লঞ্চেই শতকরা ৬০ ভাগ কেবিন এবং ৫০ ভাগ ডেক খালি থাকছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর লঞ্চের ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। নতুন রেটে ডেকের ভাড়া জনপ্রতি ৪৫৭ টাকা হলেও আমরা নিচ্ছি ৪০০ টাকা বা এরও কম। এছাড়া সিঙ্গেল ও ডাবল কেবিনে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভাড়ার তুলনায় অনেক কম নিলেও মিলছে না যাত্রী।

বরিশাল নদীবন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পদ্মা সেতু পার হয়ে কয়েক ঘণ্টায় মানুষ ঢাকা, বরিশালসহ অন্যান্য জেলায় যাতায়াত করতে পারছেন। বরিশাল থেকে ঢাকায় ৩/৪ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়। মানুষ এ কারণে লঞ্চে সময় অপচয় করে যেতে চাচ্ছেন না। যাত্রী সংকটের কারণে বরিশালের ১২টি রুটের অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছ। বরিশালেও যে হারে যাত্রী কমছে তাতে রুট কতদিন চালু থাকে তা নিয়ে শঙ্কিত আমরা। যাত্রী সংকট হলেও অতিরিক্ত ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ নেই।