ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে নির্যাতন, মুক্তিপণ দাবি

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে শাকিল মিয়া (২৪) নামে ফরিদপুরের সালথা উপজেলার এক যুবককে।

নির্যাতনের চিৎকার মোবাইলে রেকর্ড করে পাঠানো হচ্ছে তার বাবা-মায়ের মোবাইলফোনে। এমনকি আরও ১৫ লাখ টাকা না দিলে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নির্যাতিত শাকিল সালথার রামকান্তপুর ইউনিয়নের রামকান্তপুর পূর্বপাড়ার টিটুল মিয়ার ছেলে।

জানা গেছে, গত কয়েকদিন আগে একই গ্রামের মুকুল ঠাকুর নামে এক দালালের খপ্পরে পড়ে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখে শাকিল। পরে তার কথা অনুযায়ী ১২ লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান। এরপরই তার (শাকিল) ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন।

শাকিলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। অসহায় হয়ে পড়েছেন তার মা-বাবা ও স্বজনরা। গত কয়েকদিন ধরে খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে তাদের। তার মায়ের আহাজারিতে কাঁদছে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনরা। কাঁদতে কাঁদতে কিছু সময় পরপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন শাকিলে মা। সন্তানের জীবন রক্ষায় আকুতি-মিনতি ও কোনো কথায় কাজে লাগছে না মানবপাচারকারী চক্রের কাছে, তাদের দাবি আরও ১৫ লাখ টাকা পাঠাতে হবে।

শাকিলের পরিবার জানায়, গত ০৪ জানুয়ারি শাকিলকে প্রথমে ভারতে নেওয়া হয়। পরে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় নেওয়া হয়। সেখানে তাকে গত ১২ দিন ধরে অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এমনকি শাকিলের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রেখেছে চক্রটি। নির্যাতনের সময় শাকিলের মা-বাবাকে কল দিয়ে শুনানো হয় নির্মম চিৎকার। নির্যাতনকারীরা মুক্তিপণ চান বাংলায় কথা বলে।

শাকিলের পরিবার ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য একই গ্রামের মুকুল ঠাকুর নামে এক ব্যক্তি কিছুদিন আগে দেশে আসেন। দেশে এসে যুবসমাজকে লিবিয়া থেকে ইতালিতে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করার এক পর্যায়ে শাকিলকে ইতালি নিয়ে সেখানে উচ্চ বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে প্রভাবিত করে ফেলেন। মানবপাচারকারী মুকুলের ফাঁদে পড়ে বাবা-মায়ের শত চেষ্টা উপেক্ষা করে লিবিয়া যাওয়ার বায়না ধরে বসেন শাকিল। আদুরে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ও তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অসহায় বাবা-মাও এক পর্যায়ে তাকে বিদেশে যেতে কথায় রাজি হয়ে যান।

মানবপাচারকারী মুকুলের সঙ্গে শাকিলের বাবা-মায়ের কথা হলে মুকুল জানান, সর্বমোট ১২ লাখ টাকা দিলে তিনি শাকিলকে বৈধভাবে ইতালিতে নিয়ে গিয়ে উচ্চ বেতনে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। মুকুলের কথায় আশ্বস্ত হয়ে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার করে, জমি-জমা বন্ধক রেখে ও চড়া সুদে ঋণ করে ১২ লাখ টাকা জোগাড় করে তুলে দেন মুকুলের হাতে। একইভাবে শাকিলসহ চারজনের কাছে থেকে মোট ৫০ লাখ টাকা নিয়ে লিবিয়ায় ফিরে যান মুকুল।

এর কিছুদিন পরে শাকিলসহ আরও চারজনকে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। লিবিয়ায় নিয়ে শাকিলের বাবা-মার কাছে পুনরায় আরও ১৫ লাখ টাকা দাবি করে বসে মুকুল ও তার চক্রের লোকজন। তাদের দাবিকৃত ১৫ লাখ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে শাকিলকে একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে শুরু করে অমানবিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনের চিৎকার কান্নাকাটির শব্দ মোবাইলফোনে ধারণ করে পাঠাতে থাকে শাকিলের পরিবারের কাছে। নির্যাতনের এক পর্যায়ে জানানো হয় টাকা না পাঠালে শাকিলের ওপর নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন আরও বাড়বে। এমনকি তাকে হত্যা করে সাগরে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে এই দালাল চক্র। এই মানবপাচারকারিদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শাকিল ফোনে বাবা-মায়ের কাছে চিৎকার করে কাঁদে আর বলে টাকা না দিলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ওদের টাকা দাও, আমার জীবন বাঁচাও। আর এই চিৎকার শুনে বাবা-মা চরম অসহায় হয়ে চরম হতাশায় ভুগছে।

শাকিলের বাবা টিটুল মিয়া একজন কৃষিজীবী মানুষ, সাধারণভাবে তার জীবন জীবিকা চলে। কোথায় পাবে এত টাকা। যা ছিল শেষ সম্বলটুকু বিক্রয় করে, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ১২ লাখ টাকা জোগাড় করে আগেই এই পাচারকারী মুকুলের হাতে তুলে দিয়েছে। এখন যাবে কোথায়? কাঁদতে কাঁদতে -এমন কথাই বলছিলেন শাকিলের বাবা।

জানা গেছে, এই মুকুল ঠাকুর একজন প্রভাবশালী মানবপাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছদ্মবেশে রয়েছে তার সদস্য। ইতোপূর্বে এই মুকুলের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় মানবপাচারের অভিযোগে মামলা হয়েছে। কিছুদিন আগে মাদারীপুর জেলায় একটি মানবপাচার মামলার আসামি হয়ে শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে এই মুকুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে পাঠায়। আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবার পালিয়ে লিবিয়া গিয়ে মানবপাচারে যুক্ত হয় এই মুকুল।

এ ব্যাপারে সালথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ফায়েজুর রহমান বলেন, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত ভুক্তভোগী পরিবারের কেউ আসেনি। তবে ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।